ঋণ পেতে বাংলাদেশকে ৩৮টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের। মোট ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য সেই শর্ত পালনেও প্রস্তুত বাংলাদেশ। মোটা অঙ্কের এই ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত বৃহস্পতিবার ছাড় করেছে সংস্থাটি। বাকি অর্থ ২০২৬ সাল পর্যন্ত সমান ছয় কিস্তিতে ছাড় হবে। তবে প্রত্যেক কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত পালনের অগ্রগতি যাচাই করবে আইএমএফ।
বাংলাদেশের পক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার লিখিতভাবে এসব শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর আইএমএফের প্রকাশ করা কাগজপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিছু কাজ আগামী এক বছরের মাঝেই সম্পন্ন করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব শর্তের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর উদ্যোগ। জুনের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত সরকারকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে, যা আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস ও ভ্যাট উইংয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করতে হবে।
সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া কমানোরও শর্ত রয়েছে আইএমএফের। আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণ কমিয়ে চার ভাগের একভাগে নিয়ে আসতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরিকল্পনা নিতে হবে। চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ প্রস্তাব করা হয়েছে মূলত জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে। এমনকি ধীরে ধীরে ভর্তুকি শুন্যের কোটায় নিয়ে আসার শর্তও আছে। সঙ্গত কারণেই জানুয়ারি মাসে সরকারের দুই দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।
এছাড়াও আগামী জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদহারে করিডোর পদ্ধতিতে যেতে হবে। সুদহার করিডর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন করা যায়। একইভাবে জুনের মধ্যে আইএমএফের পদ্ধতিতে বৈদেশিক রিজার্ভের হিসাব শুরু করতে হবে।
একই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার করতে হবে বাজারভিত্তিক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
চলতি বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ঝুঁকিভিত্তিক সুপারভিশনে যেতে বলেছে আইএমএফ। একই সঙ্গে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া জুনের মধ্যে ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।
২০২৪ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মানতে হবে যেসব শর্ত:
২০২৪ সালের জুনের মধ্যে মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে করসংক্রান্ত নিয়মকানুন প্রতিপালনের জন্য কৌশল নিতে হবে। কর অব্যাহতি কমানো শুরু করতে হবে। ব্যাংকের খারাপ সম্পদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। সংশোধিত দেউলিয়াবিষয়ক আইন ও অর্থঋণ আদালত আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি, সরকারি গ্যারান্টি, পিপিপিজনিত ঝুঁকিসহ সরকারি রাজস্ব ঝুঁকির তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
২০২৫ সালে কর অব্যাহতি কমাতে হবে। মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল বাস্তবায়নের পাশাপাশি করসংক্রান্ত নিয়মকানুন প্রতিপালনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ও মূলধন ঘাটতি দূর করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা ছাড়াও ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। সংশোধিত হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে বাজেট ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমানোর ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন ৫০ সংস্থার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারের ক্ষেত্রে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সংস্থাটির ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
২০২৬ সালে কর অব্যাহতি কমিয়ে জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তি কর আদায়ের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে করসংক্রান্ত নিয়মকানুন প্রতিপালনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। জ্বালনির মূল্য নির্ধারণে সময়ভিত্তিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো ও মূলধন ঘাটতি দূর করার উদ্যোগ অব্যাহত রেখে তদারকি বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতের জন্য খাতভিত্তিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারের ক্ষেত্রে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন অব্যাহত রাখতে হবে। গ্রিনবন্ডের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।