সাজ্জাদ শরিফ
দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। সব নবী–রাসুলই দাওয়াত, তাবলিগ, তালিম ও তারবিয়াতের কাজ করেছেন। যেহেতু নতুন কোনো নবী ও রাসুল আর আসবেন না, তাই কিয়ামত পর্যন্ত দাওয়াত, তালিমে দ্বীনের কাজ আখেরি নবীর উম্মত তথা উম্মতে মুহাম্মদীকেই করে যেতে হবে।
ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।’ (জামে তিরমিযি)। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.)–এর সর্বশেষ বাক্য ছিল, ‘তোমরা যারা উপস্থিত রয়েছ তারা যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)। দাওয়াত তাবলিগের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সৎকাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা।
এবার একটু ভিন্নদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ইসলামের সোনালি যুগের সাথে বর্তমান সময়ের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো যে, দীন শিক্ষা করা, আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকার দীক্ষা, হেদায়েতের আলোকিত পয়গামের অনন্য সৌন্দর্য লাভের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার প্রতি শুধু শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলা হয়। বর্তমান সময়ে আরও স্পষ্টভাবে বললে বলা যায়, শুধুই মাদরাসা শিক্ষার্থীদের। কিন্তু ইসলামের সোনালি যুগে এমন ছিলো না। তখনকার সময়ে পুরো উম্মাহর জন্যই এমন শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করা ছিলো অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমান সমাজ ও সমাজের মানুষের ব্যাপারে ন্যূনতম মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না। অথচ তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং তাদেরকে ইসলামের নৈতিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলাই একান্ত প্রয়োজন এবং এর প্রয়োজনীয়তাও সবচেয়ে বেশি।
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে এমন সময় নবি-রাসুলদের এই মাটির পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যখন পুরো পৃথিবীই তাদের প্রতি অমনোযোগী থাকত। যে সময়ের মানুষজন নিজেদের প্রকমত লাভ-ক্ষতির হিসেব ভুলে থাকত। নবীগণ এসে তাদের মাঝে সন্ধানী চেতনা সৃষ্টি করতেন। কর্মঠ লোক তৈরি করতেন। ফলে নববী আলোর পরশে তারা হয়ে উঠতেন যুগের শ্রেষ্ঠ মানব। তাই যাদের মাঝে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নেই, অনুসন্ধিৎসু মন ও চেতনা নে, তাদের মাঝে সেটা জাগিয়ে তোলা তাবলিগের অন্যতম দায়িত্ব। এটা জাগরিত করা আলেম সমাজের দায়িত্ব। মানুষের মাঝে এ দীক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারলে দাওয়াত তাবলিগের ভুলগুলো থেকে বেরিয়ে প্রকৃত দায়ি হয়ে উঠত নববী আদর্শের আদলে। এটা গড়ে তোলাও আলম সমাজের দায়িত্ব ও একান্ত কর্তব্য।
ইমাম গাজালি রহ. কত সুন্দর কথা না বলেছেন! তিনি বলে, যদি কোনো ব্যক্তি একথা না জানে যে৷ সে যে কাজ করছে সেটা গুনাহ, তাহলে আলেমের দায়িত্ব হলো, তাকে সে সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এর সহজ পদ্ধতি হলো, একজন আলেম একটি মসজিদ, মহল্লা কিংবা কোনো একটা মজলিসের দায়িত্ব নিয়ে সেখানকার মানুষদের দীনি তালিম দেবেন। কোনটা উপকারী বা কোনটি ক্ষতিকর, কোন জিনিসের মাঝে প্রভূত কল্যাণ আর কোনটার মাঝে রয়েছে ধ্বংসাত্মক বিষ, সে বিষয়ে আলোচনা করবেন বিস্তারিত। কেউ দাওয়াত করলে গিয়ে আলোচনার জন্য অপেক্ষা করা যাবেনা। কিংবা মানুষ এসে জানে চাইলে বলার জন্যও অপেক্ষা করা যাবেনা। কারণ, আলেমগণ নবির ওয়ারিশ। আর নবিগণ কখনো জনসাধারণকে অজ্ঞতার মাঝে ছেড়ে দিতেন না। বরং তারা স্বউদ্যোগী হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতেন। দাওয়াত দিতেন।। একজন একজন করে খুঁজে বের করে তাদের সরল পথের দীক্ষা দিতেন। উলামায়ে কেরামের ফরজ দায়িত্ব হলো, প্রতিটি গ্রামে, মহল্লা আর শহরে একজন আলেমকে নিযুক্ত করা। যিনি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে দীন শিক্ষা দান করবেন। কারণ, বেশিরভাগ মানুষই দীন সম্পর্কে অজ্ঞ। তাই দীনের মূলনীতি ও আনুষাঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে তাকে দাওয়াত দেওয়া ও প্রচার করা আলেমদের জন্য অত্যাবশ্যক গুরু দায়িত্ব।
আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, প্রিয়নবী সা. আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন আমি তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম, একটা কিছু ঘটেছে! তিনি অজু করলেন। কারও সঙ্গে কথা বললেন না। আমি হুজরার সঙ্গে ঘেঁষে কান পেতে, তিনি কি বলেন, তা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলেন করে বললেন, হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে বলছেন, ‘তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকো। ওই পরিস্থিতির পূর্বে যে, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করবো না ; তোমরা আমার কাছে চাইবে, আমি তোমাদের চাহিদা পূর্ণ করবো না; এবং তোমরা আমার কাছে (শত্রুর বিরুদ্ধে) সাহায্য চাইবে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো না। এর চেয়ে বেশি কিছু না বলে, নবীজী সা. মিম্বর থেকে নেমে গেলেন।
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন, “আমার উম্মত যখন দুনিয়াকে বড় করে দেখবে, তাদের অন্তর থেকে ইসলাম-এর প্রভাব ও বড়ত্ব তুলে নেওয়া হবে। তারা যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ ছেড়ে দেবে,তখন ওহির বরকত থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে দেওয়া হবে। আর আমার উম্মত যখন পরস্পর গাল-মন্দে জড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে দুরে ছিটকে পড়বে।
বর্ণিত হাদিস থেকে তাবলিগের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। তাছাড়া দীন শিক্ষার গুরুত্ব ও উদাসীনতা দূর করার মাধ্যমেই এক আলোকিত সমাজ গড়ে উঠেছিলো যুগে যুগে, সময়ের ব্যবধানে। উম্মাহর দরদি কান্ডারিগণ প্রাথমিক যুগে এমন প্রয়াস চালিয়েছিলেন বলেই দীনি অনুভূতি, ইসলামের উন্নতি ও প্রসার ঘটেছিল। বর্তমান যুগে উম্মাহর মাঝে দীনদরিত্ব, ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও দীনি চেতনার যে মশাল দেখতে পাই, সেটা তাদেরই মেহনতের ফসল। যা রাসুল সা., সাহাবায়ে কেরাম রা. এব যুগে যুগে উম্মাহর কান্ডারিগণের দোয়া, চেষ্টা, মেহনত এবং জিহাদ ও কুরবানির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। আজও আমরা তাবলিগকে মনে করি যে এটা আমার কাজ। আমার দায়িত্ব। তাহলেই উম্মাহ আবার জেগে উঠবে নববী আদর্শের আলোকিত দীক্ষায়। পৃথিবী ফিরে পাবে তার সোনালি অতীত এবং সোনালি সৌন্দর্য। সমাজ ও সমাজের মানুষ হবে ইসলামের সোনালি যুগের মত আদর্শ ও আলোকিত মানুষ।