আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবেও পরিচিত তিনি। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণই পরিব্যাপ্ত তার কবিতায়।
আজ বুধবার (১৯ অক্টোবর) প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের এইদিনে ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে বিপ্লবদীপ্ত এই কবি মৃত্যুবরণ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আখতার। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি।
১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএতে ভর্তি হন। কিন্তু নানাবিধ কারণে পড়াশুনা আর শেষ করতে পারেননি।
১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে চাকরির মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। কবি ফররুখ আহমদ প্রথম যৌবনে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কমরেড এমএন রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি একসময় ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী সমাজতন্ত্র মূর্ত হয়ে ওঠে।
কবি ফররুখ আহমদ সৃষ্ট সাহিত্যসম্ভার ভাষা তথা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। দর্শনগতভাবে তিনি ছিলেন মানবতাবাদী কবি। নীতি আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। কবি ফররুখ আহমদের চিন্তাচেতনা দর্শন সবই ছিল এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। তার কবিতা ছিল মানবতাবাদী দর্শনে পরিপূর্ণ। কিন্তু কাব্যে রসবোধেরও কমতি নেই।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-স্বীকৃত একজন অসাধারণ জননন্দিত কবি ফররুখ আহমদ। কবির সাহিত্য জীবনের শুরুতে ‘সওগাত’ পত্রিকায় ফররুখ সম্পর্কে আবু রুশদ লিখেছেন- ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি, অর্থাৎ তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব-বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তার কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ, সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তার কাব্যের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবুও তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক। এমনিভাবে প্রখ্যাত অনেক সমালোচক সাহিত্যিক ফররুখ আহমদ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন।
মানবতাবাদী ও জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ একজন আধুনিক ও সৃষ্টিশীল কবি হওয়ার পরও আত্মপরিচয় ভোলেননি কখনো। সাহিত্য সাধনার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় তিনি আত্মবিমুখ হননি বরং তার কাব্য ও রচনায় ‘বাঙালি মুসলিম’ পরিচয়টি জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন বারংবার।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ এর পরে অন্যতম সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদ রচিত ‘হাতেম তায়ী’। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃৎ তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও সফল তিনি। শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদসাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
ছন্দের কবি, সঙ্গীতঝঙ্কারের কবি ফররুখ আহমদের কাব্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বদেশ, সমকাল ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। অফুরাণ সৌন্দর্য, উদাস কল্পনা, রূঢ় বাস্তবতা, প্রদীপিত আদর্শ, সমুদ্রবিহার, রোমান্টিকতা, প্রেম প্রভৃতি তার কবিতার এক মৌলিক চরিত্র নির্মাণ করেছে।
এছাড়া গানের ভুবনেও তার পদচারণা ছিল সর্বত্র। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শিল্পী ও গীতিকার হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পান। ফররুখ আহমদের লেখা গান আজও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নতুন প্রজন্মকে। ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া’- এমনি অসংখ্য গান-কবিতা আর সাহিত্যর মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে যুগ যুগ প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন কবি ফররুখ আহমদ।