অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন এমনকি হত্যা বাংলাদেশে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, সাংবাদিক নির্যাতন করলে, হত্যা করলে যে কোনো শাস্তি হয় না, এমন ধারণা এক প্রকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ জামালপুরে গোলাম রব্বানি নাদিম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এমন ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হওয়া অমূলক নয় যে, গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রোধে যে কোনো কিছুই করা যায়।
শুক্রবার (১৬ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলে টিআইবি। পাশাপাশি সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের পরিবারের সূত্রে জানা যায় যে সংবাদ প্রকাশের জেরে বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধি তাকে নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। তার লোকজনই তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর ফেরার পথে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, শুধু তাই নয় গত ১১ এপ্রিল গোলাম রব্বানিকে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাও মারধর করেছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদে জানা যায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জেরে গোলাম রব্বানি হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেই সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান ও তাদের যোগসাজসকারী কর্তৃক সাংবাদিকের ওপর হামলা-নির্যাতন, আটক, গুম ও এমনকি হত্যা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিককালে সাংবাদিকদের ওপর সংঘঠিত বিভিন্ন হামলা, মামলা ও নির্যাতনের প্রতিরোধে প্রশাসনিক ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সাফল্যের ঘাটতি, নির্লিপ্ততা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখা গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে হামলাকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, যার সর্বশেষ নিদর্শন জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধররা নিজেদের দুর্নীতি-অন্যায় লুকিয়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তারা কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেই বিচারহীনতা ভোগ করবেন, এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, মুক্ত সাংবাদিকতার এই সংকট নিরসনে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তবে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক সরাসরি জড়িতদের পাশাপাশি যাদের নির্দেশে, যোগসাজসে ও যাদের স্বার্থ সুরক্ষায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২৩-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছর থেকে এক ধাপ নেমে ১৬৩ হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, গত দুই বছরে বাংলাদেশ ১১ ধাপ ও ১৪ বছরে ৪২ ধাপ নিচে নেমেছে। যে বিষয়গুলোর ওপর এই সূচক নির্ধারিত হয়, তার অন্যতম একটি হলো সাংবাদিকের নিরাপত্তা। আর ঠিক সেখানেই বাংলাদেশের স্কোর হতাশাজনকভাবে কম। সূচকের পাশাপাশি প্রায় নিয়মিতভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশ মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে কী ধরনের বিব্রতকর অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, সাংবাদিক নির্যাতন করলে এমনকি হত্যা করলে যে কোনো শাস্তি হয় না, এমন ধারণা এক প্রকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ জামালপুরে গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এমন ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হওয়া অমূলক নয় যে, গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রোধে যে কোনো কিছুই করা যায়। যার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো রয়েছেই। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের দায় সরকারের।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গোলাম রব্বানিসহ সব সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, অবিলম্বে অভূতপূর্ব নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।