চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের টিকটকার মাহফুজা আক্তারের (২২) বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের উদ্দেশ্যে তথ্য নিতে চাইলে উল্টো তিনজন সাংবাদিকসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে দর্শনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ওই টিকটকার।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দর্শনা থানায় এ জিডি করা হয়। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জুয়া খেলা এবং তার প্রচার সম্পূর্ণ বেআইনি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডি গ্রহণ করায় স্থানীয় সাংবাদিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা হলেন ঢাকা পোস্টের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি ও দৈনিক মাথাভাঙ্গার স্টাফ রিপোর্টার আফজালুল হক, দৈনিক মাথাভাঙ্গার দর্শনা ব্যুরো প্রধান হারুন রশিদ রাজু, অনলাইন নিউজ পোর্টাল নীলকণ্ঠের ডেস্ক ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুন, জীবননগরের তুহিন উজ্জামান এবং মুহাম্মদ শাওমিন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেনের মেয়ে মাহফুজা আক্তার তার টিকটক আইডিতে ১ মিনিট ২ সেকেন্ডের একটি অনলাইন জুয়ার ভিডিও আপলোড করেন।
ভিডিওটি আপলোডের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
জিডিতে মাহফুজা আক্তার উল্লেখ করেন, আমি মাহফুজা আক্তার, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভুলবশত একটি গেমের (ক্যাসিনো) বিজ্ঞাপন প্রকাশ করি। পরে বুঝতে পারি এটি আইনগত অপরাধ, ফলে ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেটি আমার প্রোফাইল থেকে ডিলিট করে দিই। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি।
তিনি আরও দাবি করেন, গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে একটি নৃত্যে অংশগ্রহণ করি। সেই নাচের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘রেডিও চুয়াডাঙ্গা’র ফেসবুক পেজে আপলোড হলে তা ভাইরাল হয়।
এরপর জনৈক আফজাল হোসেন, যিনি নিজেকে রেডিও চুয়াডাঙ্গার মালিক হিসেবে পরিচয় দেন, আমাকে একাধিকবার ফোন করে জুয়ার বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি তাকে জানাই, এটি ভুলবশত হয়েছিল এবং ডিলিট করেছি।
মাহফুজা আক্তার অভিযোগ করেন, ১৫ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আমাকে ফোনে জানানো হয়, বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানানো হয়েছে এবং আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে, একইসঙ্গে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর আফজালুল হকসহ অন্যান্যরা তাদের আইডিতে পুরনো ভিডিও আপলোড করে আমার সম্মানহানি করছেন এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিক আফজালুল হক বলেন, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে মাহফুজা আক্তারের নাচের ভিডিও আমাদের রেডিও চুয়াডাঙ্গা পেজে আপলোড করা হয়। এরপরই জানতে পারি, তিনি আগে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন।
তিনি আরও বলেন, খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ১৫ এপ্রিল তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাই। তিনি স্বীকারও করেন। এরপর পুলিশ সুপারকে জানানো হয়, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান। তাকে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি, বরং তার সাথে হওয়া পুরো কথোপকথন আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।
আফজালুল হক বলেন, নিষিদ্ধ জুয়ার প্রমোটকারী হয়েও উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডি করা হলো, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। পুলিশ যেখানে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেখানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডি নেয়া হয়েছে।
আরেক সাংবাদিক সাদিকুল ইসলাম বলেন, উপযুক্ত বিচারের প্রত্যাশায় আমি ওই জুয়ার বিজ্ঞাপনের ভিডিওটি আমার আইডিতে আপলোড করেছিলাম। একজন জুয়ার প্রচারকারীকে আইনের আওতায় আনার পরিবর্তে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডি গ্রহণ অত্যন্ত হতাশাজনক। আমরা আশা করি, পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
এ বিষয়ে হারুন রশিদ রাজু নামের এক সাংবাদিক বলেন, জুয়া ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি জাতিকেও ধ্বংস করে। অনলাইন জুয়ার প্রভাব এখন ভয়াবহ। জুয়া প্রমোট করা অবশ্যই অপরাধ। সেই অপরাধের প্রতিবাদ করার কারণে যদি সাংবাদিকদের জিডির খেসারত দিতে হয়, তাহলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমি পুলিশ সুপার ও দর্শনা থানার ওসির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন যথাযথ তদন্ত করে দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এদিকে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডির ঘটনায় চুয়াডাঙ্গার সাংবাদিক মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাজিব হাসান কচি বলেন, সংবাদ প্রকাশের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট পক্ষের বক্তব্য নেওয়া সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে জিডি করা অনভিপ্রেত। আমরা চাই, জুয়ার বিজ্ঞাপনকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা জিডি প্রত্যাহার করা হোক।
চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিপুল আশরাফ বলেন, পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই, নিরপেক্ষ তদন্ত করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা জিডি প্রত্যাহার করা হোক এবং যারা অনলাইনে জুয়া প্রচারণায় যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
এ বিষয়ে দর্শনা থানার (ওসি) শহীদ তিতুমীর বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।