জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষার্থীদের জন্য সাবেক আওয়ামী এমপি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিনামূল্যে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচির উদ্যোগে গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে জাবি শাখা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে। তবে টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বের কারণে টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ তথ্য অস্বীকার করেছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও জাবি শাখার নেতারা।
শাখা ছাত্রদল কর্তৃক গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত ২০ এপ্রিল বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। পরে ১৯ এপ্রিল রাতে হঠাৎ কর্মসূচি স্থগিত করে সংগঠনটি। বিজ্ঞপ্তিতে অনিবার্য কারণবশত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে বলে জানানো হয়।’
ভ্যাক্সিনেশন স্থগিতের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচির আড়ালে আওয়ামীপন্থী এক সাবেক এমপির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেওয়া হচ্ছে। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী (মহুল)। এছাড়া তিনি রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিকেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
জাবি শাখা ছাত্রদল ও রেডিয়ান্ট ফার্মাসিউটিকেলসে কর্মরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাবেক এমপি জাহেদী ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নানাভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এতে তিনি কাজে লাগিয়েছেন তার বিপুল পরিমাণ অর্থ। তার ভাই কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী (হিজল) ছিলেন ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র।
এছাড়া, গত বছরের নভেম্বরে মহুল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি নির্বাচিত হলে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ঝিনাইদহ জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য ও ব্যবসা-রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে বিভিন্নভাবে অর্থ ব্যয় করছেন জাহেদী। আর এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছেন শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফয়সাল হোসেন। তিনি রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিকেলসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও জাবি শাখা ছাত্রদলের সাবেক কর্মী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে মহুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে অর্থ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিনামূল্যে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। নজরুল ইসলাম ও ফয়সাল দুজনেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকার সুবাদে নিজেদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ রয়েছে।
জাবি শাখা ছাত্রদলের কমিটিতে রয়েছে এমন তিনজন যুগ্ম-আহ্বায়ক ও দুইজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, এই কর্মসূচির বরাতে মোট ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা বাজেট ছিল। যার মাধ্যমে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে ৩ ধাপে ৩০ হাজার ডোজ টিকা প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিকেলস বাজারজাত না করায় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিকেলস থেকে ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইনসেপ্টা ফার্মসিউটিকেলস হেপাটাইটিস-বি এর ভ্যাক্সিন ‘হেপা-বি’ নামে বাজারজাত করে থাকে। এর প্রতি ১০ মাইক্রোগ্রাম /০.৫ মিলিলিটার ডোজের মূল্য ৪৫০ টাকা। সে হিসেবে ৩০ হাজার ডোজ টিকার মূল্য দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তাই হিসেবে টিকার মূল্য পরিশোধ করেও উদ্বৃত্ত থাকে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
আর উদ্বৃত্ত অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে উদ্যোক্তা ফয়সাল, জাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, সদস্য সচিব ওয়াসিম আহমেদ অনীক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা গিয়েছে।
উদ্যোক্তা হিসেবে উদ্বৃত্ত অর্থ ফয়সাল একাই নিতে চাইলে বিপত্তি বাঁধে বাবর ও অনীকের সঙ্গে। পরে বিষয়টি জানতে পেরে এ অর্থের ভাগ চান নাসির। বিষয়টি মিমাংসা না হলে এক পর্যায়ে নাসির বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলকে বিচার দেন। বকুল এ কর্মসূচিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের তত্ত্বাবধানে করার নির্দেশ দেন।
বিষয়টি নিয়ে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, যুগ্ম-আহ্বায়ক ফয়সাল, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির ও রেডিয়েন্টের এজিএম নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাখা ছাত্রদলের এক কর্মী বলেন, ’মূলত টাকা ভাগাভাগি নিয়েই এই ভ্যাক্সিন দেওয়া বন্ধ করা হয়। তবে এই মুহূর্তে কেন্দ্র প্রোগ্রামটি নিতে চাচ্ছে।’
শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফয়সাল হোসেন বলেন, আমাদেরকে বাজেটটি নিশ্চিত করেনি। তবে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটির কাছাকাছি হবে বলে প্রাথমিক ধারণা করছি। আমরা সাবেক ছাত্রনেতা নজরুল ভাইয়ের মাধ্যমে বাজেটটি পেয়েছি। তাই এ বিষয়ে তিনিই বলতে পারবেন।
টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ’আমরা কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন করছি না। রেডিয়েন্ট ফার্মাসিটিক্যালস আমাদের শুধু প্রোডাক্ট দিবে এবং তারা তাদের মতো করে লোকবল দিয়ে এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। আমারা কিছু দিন সময় নিচ্ছি সুশৃঙ্খল ম্যানেজমেন্ট এবং স্কেনিংয়ের জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি এখানে ইস্যু না, এখানে একটা ভালো কাজের জন্য নেয়া হয়েছে। আমি আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এটা পেয়েছি। তাকে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে— এমন কথার ভিত্তি নেই’।
রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিকেলস থেকে টিকা প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করে নজরুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়ররা গুরুত্বপূর্ণ। এটি করতে পেরে ভালো লাগছে। অভিযোগ গুলোর ব্যাপারে একাধিকবার জিজ্ঞেস করলেও বক্তব্য দেননি তিনি। এগুলো ফয়সাল কর্মসূচী নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব ওয়াসিম আহমেদ অনীক বলেন, আমি এসব বিষয় (টিকার উৎস ও বাজেট) নিয়ে অবগত নই। উনি (ফয়সাল) ভালো বলতে পারবেন।
অর্থ ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি অস্বীকার করে জহির উদ্দিন বাবর বলেন, প্রোগ্রামটাকে কিভাবে সুন্দর করা যায় সে বিষয়ে বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক বকুল ভাই এবং কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা চলমান তাই প্রোগ্রাম স্থগিত করা হয়েছে। রেডিয়েন্ট ফার্মাতে আবেদন করে আমরা এটি পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত রেডিয়েন্ট ফার্মার চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে ডামি এমপি ছিলেন। কিন্তু অর্থে বিষয়টি আমরা পুনর্বাসন হিসেবে দেখছি না। এর আগেও তো বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন জায়গায় স্পন্সর করেছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির প্রথমে ২০ এপ্রিল টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা স্বীকার করলেও পরে কর্মসূচির তারিখ ঘোষণার বিষয়ে তিনি অবগত নয় বলে জানান।
নাসির বলেন, আমার এবং জাবি ছাত্রদলের মাঝে সমঝোতা হয়নি বলে এ কর্মসূচি স্থগিত হয়েছে— বিষয়টি সত্য নয়। টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু এ বিষয়ে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ভ্যাক্সিনেশনের বিষয়টি রেডিয়েন্ট ফার্মাসিটিক্যালস থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে, সাবেক এমপি হিসেবে নয়। আর এটা আনঅফিসিয়ালিই রয়েছে, এখনও অফিসিয়ালি কিছু হয়নি।
কেন্দ্র সিদ্ধান্ত না দিলে এ নিয়ে জাবি ছাত্রদল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলো কীভাবে?-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিজ্ঞপ্তি দেখে মন্তব্য করবেন বলে জানান। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হলেও তা দেখে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।