তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ যেন এক মহাকাব্যের মতো, যেখানে ত্যাগ, সংগ্রাম আর বেদনার এক অজানা গল্প বয়ে চলে। বলছিলাম, জুলাই বিপ্লবের এক যোদ্ধার মায়ের কথা, যিনি ভাগ্যপরিক্রমায় তার সন্তানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বেদনাদায়ক স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমরা শুনেছি, কীভাবে একজন মা তার সন্তানকে দেশের জন্য, জাতির জন্য নিজের সব কিছু ত্যাগ করার সাহস জুগিয়েছিলেন। সেই যোদ্ধার নাম সারাফ সামির জামান মেঘ। মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র, যিনি নিজের প্রাণপণ লড়াই দিয়ে কুমিল্লার উত্তাল রাজপথে অংশ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান—জুলাই বিপ্লবে। কামরুন নাহার শীলার, বর্ণনা করা একেকটি শব্দ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি বিপ্লবের পেছনে থাকে অসংখ্য জীবন, অসংখ্য কষ্ট।
কুমিল্লার ভূমিকা: সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু
কুমিল্লা, দেশের অন্যতম পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শহর, জুলাই আন্দোলনের সময় হয়ে উঠেছিল এক বিশেষ সংগ্রামক্ষেত্র। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। মেঘের মা বলছেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তখন শুধু তারা নয়, কুমিল্লার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সাড়া দিয়েছিল। এমন এক ঐক্য আমি আগে কখনো দেখিনি।’ আন্দোলনটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছিল না, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার সাধারণ জনগণও। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, একে একে সবাই নেমে এসেছিল রাস্তায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঐক্যই ছিল আন্দোলনের প্রধান শক্তি। মেঘের মা জানান, ‘শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এত রক্ত, এত মৃত্যুর পরেও তাদের কেউ দমাতে পারেনি। আন্দোলনটি এক ঐতিহাসিক আন্দোলন হয়ে উঠেছিল, এবং কুমিল্লার ছাত্ররা তার নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিল।’
এক যোদ্ধার মায়ের গল্প: মেঘের সংগ্রাম
কিন্তু, এই আন্দোলনের এক অমলিন গল্প হলো মেঘের—এক দশম শ্রেণির ছাত্রের সাহসী পদক্ষেপ। মেঘ ছিল না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তবে তার মন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত। আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে সে তার মায়ের কাছে বলেছিল, ‘পুলিশি নির্যাতনের ভিডিও দেখেছিলাম, খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। প্রতিবাদ করাটাই আমাদের দায়িত্ব।’
মেঘের মায়ের ভাষ্যে— ‘সে আমার একমাত্র সন্তান। আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল, যখন শুনলাম সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, জানতাম না তাকে আর ফিরে পাবো কিনা। হাসপাতাল যেতে আমি একদম পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু পুলিশ আমাকে বারবার বাধা দিচ্ছিল। হাসপাতালের অবস্থা এমন ছিল যে, আহতদের নেওয়ার জন্য স্থান ছিল না। আমি জানি, আমি কত ভাগ্যবান যে, মেঘ চিকিৎসা পেয়েছে, কিন্তু কত মা আছেন যাদের সন্তান আর ফিরে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল ছিল ওভারক্রাউডেড। ইমার্জেন্সি রুমে কোনো স্ট্রেচার ছিল না, আহতদের দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছিল— যেন এক যুদ্ধের সম্মুখীন। একদিকে চিকিৎসা দিতে দেওয়া যাচ্ছিল না, অন্যদিকে শুনছিলাম, আহত শিক্ষার্থীদের ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, মোবাইলে ব্যালেন্স নেই—সেসব মুহূর্তের কথা ভাবতেই এখন আমি শিউরে উঠি।’
তবে, মেঘের মা জানাচ্ছেন, তার সন্তান বেঁচে ফিরেছে, আর এটা তার জন্য এক আশীর্বাদ। কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, মেঘের মতো হাজারো শিক্ষার্থীর রক্তে রাঙানো এই বিপ্লবের শেষ হবে কি? মেঘের মা, শহীদ এবং আহত শিক্ষার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘যতদিন বেঁচে আছি, আমি চাই, এই বিপ্লবের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের ত্যাগ যেন অপমানিত না হয়। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের মুক্তির প্রতীক।’
নতুন বাংলাদেশে প্রত্যাশা: শান্তি, ন্যায় ও নিরাপত্তা
এতসব কষ্টের পর, মেঘের মা তার স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? তিনি বলেন, ‘আমরা ৭১-এ যে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, তা সঠিকভাবে পূর্ণতা পায়নি। তবে, জুলাই আন্দোলন আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমি চাই, নতুন বাংলাদেশ হোক বৈষম্যহীন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ আমাদের চাওয়া। যেখানে সবাই নিরাপদে বাস করতে পারবে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।’
সরকারের কাছে প্রত্যাশা: সুষ্ঠু পরিবেশ ও বিচারহীনতার সমাপ্তি
সরকারের কাছে মেঘের মায়ের প্রত্যাশা একেবারে স্পষ্ট— ‘গণঅভ্যুত্থানের পর, পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি, এবং উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে মব জাস্টিস, বিচারহীনতা, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। আমাদের জনগণের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা নির্ভয়ে কথা বলতে পারবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।’
তার মতে, ‘বিপ্লবের চেতনা রক্ষা করতে সরকারকে কোনোভাবেই সহিংসতা বা বিচারহীনতা হতে দিতে পারে না। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো— শহীদ শিক্ষার্থীদের ত্যাগ যেন অপমানিত না হয়। তাদের আত্মত্যাগকে আমাদের সম্মান জানাতে হবে।’
শেষ কথা: বিপ্লব ও সংগ্রামের চিরকালীন প্রেরণা
জুলাই বিপ্লবের এই গল্প শুধুমাত্র এক মায়ের দুঃখের কাহিনী নয়, এটি একটি জাতির সংগ্রামেরও প্রতীক।
মেঘের মা এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী অধ্যাপক জানেন, এই বিপ্লবের চেতনা কখনো ম্লান হবে না। ‘স্বাধীনতা অর্জন কঠিন, কিন্তু তা রক্ষা করা আরও কঠিন’,—এই কথাটাই তার জীবনের মর্ম। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশকে এক দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক, এবং ন্যায়বিচারের দেশে পরিণত করতে হলে, শহীদদের ত্যাগ এবং মেঘের মতো যোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাসের মূল্যায়ন করতে হবে।
যেহেতু মেঘের মা তার একমাত্র সন্তানকে হারানোর ভয় দেখেও, এক বিপ্লবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে—এই জাতির মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার রক্ষার সংগ্রাম।