জুলাই বিপ্লবের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। নদীভাঙনের কবল থেকে মুক্তিতে তাদের পাশে দাঁড়াবেন সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন এমনটাই প্রত্যাশা রেখেছিলেন। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, শুধু হাত বদল হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। এতে ভাঙনের কবলে পড়ে কবে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পড়বেন সেই আতঙ্কেই কাটছে নদীপাড়ের মানুষজনের।
ছোট ফেনী নদীতে নিয়মিতই অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে তীব্র নদীভাঙনে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় মুছাপুর ক্লোজার ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। এবার ভারী বর্ষণ ও বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলনের ফলে নদী গভীর হয়ে যাওয়ার ফলে নদীপাড় ভাঙন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে চান্দলা, ছয়ানি, বদরপুর গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। নদীপাড়ের মানুষের মাঝে রয়েছে ভয়াবহ আতঙ্ক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিক জানান, বড় ভাইয়েরা বাঁকা নদী সোজা করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়েছেন। সরকারি অফিস থেকে অনুমতি নেওয়ার পর আমরা এখান থেকে বালু তুলছি। কিন্তু এলাকার লোকজন বারবার আমাদের বাধা দিচ্ছে। হামলা করারও চেষ্টা করছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ছয়ানি গ্রামের পাশে ছোট ফেনী নদীতে ড্রেজিং মেশিন ও পাইপ বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর অপর পাশে নদীভাঙনে বসতঘর, ভিটেমাটি, গাছপালা নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। অথচ এলাকাবাসীর একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও প্রশাসন কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কুঠিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, মুছাপুর ক্লোজার ভাঙা ও নদী থেকে অনবরত বালু উত্তোলনের কারণে আমাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি সব নদীতে চলে যাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছি না। আমার পাকা ঘরটি দু-এক দিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, আমরা বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে বাধা দিলেও প্রভাবশালী চক্র আবারও ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে নিচ্ছে।
মতিন নামে ভিটেমাটি হারানো এক দিনমজুর বলেন, নদীতে আমার ঘরবাড়ি সবই চলে গেছে। থাকার মতো আর কোনো জায়গা নেই। কোনো ছাউনি পর্যন্ত দেওয়ার উপায় নেই। আমাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।
এদিকে বদরপুর জামে মসজিদ এলাকার জসিম নামের এক ব্যক্তি জানান, এলাকাবাসীর অনুদানে আমাদের মসজিদটি গড়ে উঠেছে। নদী ভাঙনের ফলে মসজিদটির পাশের রাস্তার অর্ধেক নদীতে চলে গেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মসজিদটিও নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে।
নদী ভাঙনের বিষয়ে ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রবিউল হক শিমুল বলেছেন, ২০২৪ সালের আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালীর মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার পর ছোট ফেনী নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এর ফলে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙনে বসতবাড়ি, কৃষিজমি এবং চলাচলের রাস্তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, অবিলম্বে নদীভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে পুরো জনপদ হুমকির মুখে পড়বে। এ বিষয়ে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ছোট ফেনী নদীতে কোন বালু মহালের ইজারা নেই এবং বাঁকা নদী সোজাকরণের কোন প্রকল্প চলমান নেই। একটি অসাধুচক্র এসব বলে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। ছোট ফেনী নদীর সোনাগাজী চরমজলিশপুর ইউনিয়নে একটি চক্র বেশকিছুদিন যাবত অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছে এমন খবর আমরা পেয়েছি। এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযান পরিচালনার জন্য বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করার অনুরোধ জানান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়া হলেও প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে নদীভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের মানুষ।
তারা দাবি করেন, দ্রুত বালু উত্তোলন বন্ধ এবং নদীতীর রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চরমজলিশপুর ইউনিয়নের একটি বড় অংশ বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।