চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে একপর্যায়ে টেনেহিঁচড়ে
নিয়ে আসা হয় থানায়। এরপর অস্ত্র মামলার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় ১৫ লক্ষ টাকা। ঘটনাটি ঘটেছে পুরান ঢাকার এক পরিবহণ ব্যবসায়ীর সাথে। ভুক্তভোগী পরিবহণ ব্যবসায়ীর নাম মোক্তার হোসেন। হাজতে তাকে আটকে রেখে স্ত্রীর কাছ থেকে এ টাকা আদায় করেছেন চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম।
এ সময় অস্ত্র ও মাদক মামলার ভয় দেখান। এ ব্যবসায়ীকে টাকার দাবিতে দুদিন আটকে রেখে নির্যাতনও চালান হয়। এরপর টাকা হাতে পেয়ে একটি কথিত মামলায় পাঠানো হয় জেলে। সেখান থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন মোক্তার হোসেন। মামলার বাদী দেখানো হয় আমিনুল হক মুরাদকে।
তবে এজাহারে প্রকৃত ঘটনা নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। এ ছাড়াও গ্রেফতারের স্থান ও সময় নিয়ে এলোমেলো তথ্য দেওয়া হয়৷
গত ২৬ জানুয়ারি রাত ১ টায় গাড়ি ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেনের পুরান ঢাকার বাড়ির সামনে আসেন চকবাজার থানার এসআই অলিউল্লাহর নেতৃত্বে পুলিশের একটি সিভিল দল। গভীর রাতে সাদা পোশাকের লোকজন দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় নিরাপত্তারক্ষী আলমগীর। সে বাড়ির গেট খুলতে অস্বীকার করলেও তাকে ভয়ভীতি দেখালে গেট খুলে দেয়। পুলিশের দলটি নিরাপত্তারক্ষী ও বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন মোক্তার ও তার স্ত্রীকে। ঘুম থেকে জেগে ওঠে তাদের তিন কন্যা। গভীর রাতে বাসায় পুলিশ দেখে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ব্যবসায়ীকে এ সময় এসআই অলিউল্লাহ বলেন, ‘ওসি স্যার আপনাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। আপনাকে থানায় যেতে হবে। চা খেয়ে চলে আসবেন।’ গভীর রাতে মোক্তার থানায় যেতে রাজি না হওয়ায় তার ওপর চড়াও হন অলিউল্লাহ। এরপর বাধ্য হয়েই পুলিশ টিমের সঙ্গে থানায় যান মোক্তার। থানায় যাওয়ার পর অস্ত্র ও মাদক মামলার ভয় দেখিয়ে গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি আবদুল কাইয়ুম। মামলার আতঙ্কে ওসিকে দিতে হয় ১৫ লাখ টাকা।
এ ঘটনার পরও থেমে থাকেননি ওসি। কথিত একটি দুর্বল মামলায় (প্রতারণার) তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম শনিবার রাতে একজন সাংবাদিককে বলেন, ‘আপনার একাধিক কলিগের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো বানোয়াট। মোক্তার একজন ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীর ট্রাকে ডিভাইস বসিয়ে মালামাল তছরুপ করেন। এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়।’
মোক্তারের স্ত্রীর কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন-জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এ বিষয়ে যদি কোনো তথ্য নিতে চান তাহলে থানায় আসেন। সরাসরি কথা বলব।’
আটকের স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি
লালবাগের সাফ গার্ডেনের ভাড়া বাসা থেকে ব্যবসায়ী মোক্তারকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মোক্তার হোসেনকে ইমামগঞ্জের মহিউদ্দিন লেনে বাদীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আটক করা হয়েছে। তাকে ২৬ জানুয়ারি রাত দেড়টায় আটক করা হলেও এজাহারে সময় উল্লেখ করা হয় ২৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা।
এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। গোটা বিষয় নিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আইজিপির কাছে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী। এ সংক্রান্ত অভিযোগ এবং মামলার কপি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
মোক্তার হোসেনকে গ্রেফতারের দুদিন পর ২৮ জানুয়ারি আদালতে হাজিরের সাথে সাথে জামিন পেয়ে যান। এর কারণ হিসাবে দুর্বল এজাহারকে দায়ী করার পাশপাশি বাদী আমিনুল হক মুরাদ জানান, ‘তিনি নিজেই দুর্বল এজাহার লিখতে পুলিশকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আসামিকে ছেড়ে দিতে পুলিশের কাছে তিনি নিজে তদবির করেছেন বলেও জানান। বিষয়টি স্বীকার করে মোক্তার হোসেনও।
মোক্তার হোসেন বলেন, ‘২৭ জানুয়ারি বিকালে আমার স্ত্রী ভ্যানেটি ব্যাগে টাকা নিয়ে সরাসরি ওসির রুমে প্রবেশ করেন। এক হাজার টাকার ১৫টি বান্ডিল ওসির হাতে তুলে দেন। থানায় থাকা ওইদিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করলেই সত্যতা বেরিয়ে আসবে। টাকা লেনদেন হয়েছে বলেই দুর্বল মামলায় আপত্তি দেননি মুরাদ।’
ঘটনার বিষয়ে ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন আরও বলেন, আমি ৫১ নম্বর লালবাগ সাফ গার্ডেনের বাসায় থাকি। গত ২৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে চকবাজার থানার এসআই ওয়ালিউল্লাহ পাঁচ সদস্যের একটি টিম নিয়ে সাদা পোশাকে বাসার সামনে আসেন। নিরাপত্তারক্ষী আলমগীরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পুলিশ সদস্যরা বাসায় প্রবেশ করেন। গভীর রাতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের মোটরসাইকেল করে চকবাজার থানায় যাই। আমার সঙ্গে মোটরসাইকেলে এসআই ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন। আমার স্ত্রী সঙ্গে যেতে চাইলেও তিনি তাকে যেতে দেননি।’
থানায় যাওয়ার পর ওসি মোক্তারকে বলেন, ‘তুই তো ব্যবসা করিস, তোর অনেক টাকা। তোর নামে অস্ত্র মামলা হবে। তোর নামে কি কোনো মামলা আছে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই-তিন বছর আগে আমার ট্রাক ভাড়া নিয়েছিলেন অবৈধ পলিথিন ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম মুরাদ। ওই ট্রাকে করে তার কারখানায় উৎপাদিত পলিথিন বিভিন্ন জেলায় পাঠাত। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া হাইওয়ে পুলিশ পলিথিনের দুটি মামলা দিয়েছিল। ট্রাকের মালিক হিসাবে আমাকেও আসামি করে। আমি জানতাম না, ট্রাকে কী নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।’ এই কথা শুনে ওসি বলেন, ‘তোর ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে, না হলে ছাড়ব না। অস্ত্র, মাদক মামলা দেব।’
এদিকে স্বামী বাসায় ফিরছেন না দেখে, রাত ৩টার দিকে স্ত্রী রোকেয়া বেগম চকবাজার থানায় যান। এ সময় মোক্তার তার স্ত্রীকে জানান, ওসি ৫০ লাখ টাকা চায়, তা না হলে ছাড়বেন না। পরে মোক্তারের স্ত্রীকে পলিথিন ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম মুরাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ওসির সঙ্গে মুরাদের সুসম্পর্ক। পরদিন ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার সকালে রোকেয়া বেগম পলিথিন ব্যবসায়ী মুরাদের বাসায় যান।
এ বিষয়ে মোক্তারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, মুরাদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে আমি আমার স্বামীকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলি। তিনি আমাকে কিছু বকাঝকা করার পর বলেন, আপনি বাসায় যান। জুমার নামাজের পর ওসি থানায় এলে তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন। মোক্তারকে ওসি ছেড়ে দেবেন।’ মুরাদের বাসা থেকে বের হয়ে রোকেয়া ওসিকে ফোন করেন। এ সময় ওসি ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে একা থানায় যেতে বলেন। কোনো পুরুষ সঙ্গে না নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওসির নির্দেশনা অনুযায়ী ২৭ জানুয়ারি বিকালে রোকেয়া বেগম একাই চকবাজার থানায় যান।
রোকেয়া বেগম বলেন, ‘ওসি আমার কাছেও ৫০ লাখ টাকা চান। আমি তাকে বললাম, এত টাকা কোথায় পাব? আমার স্বামী হাজতে। বাসায় একটি টাকাও নেই। এক পর্যায়ে ওসিকে বলি, স্যার ৫ লাখ টাকা দিবো।’ তিনি বলেন, ‘হবে না। মামলা দেব।’ এরপর আমি দশ লাখ টাকার কথা বলি। এতেও তিনি রাজি হন না। ওসি আমাকে বলেন, ‘১৫ লাখ টাকা লাগবে। আর কম হবে না।’
স্বামী মোক্তারকে হাজতে গিয়ে এ তথ্য জানান, ওসি ১৫ লাখ টাকার কমে ছাড়বে না। এ সময় মোক্তার ব্যবসায়ী আজিজুল হক ইকবালের কাছে টাকা চান। ইকবালের বাসায় মোক্তার তার স্ত্রীকে টাকা আনার জন্য পাঠান। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইকবালের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা এনে ওসির কক্ষে যান রোকেয়া বেগম।
রোকেয়া বলেন, এক হাজার টাকার নোটের ১৫টি বান্ডিল ওসিকে দিই। এরপরও আমার স্বামীকে ছাড়ছিল না। কারণ জানতে চাইলে ওসি বললেন, এভাবে ছাড়া যাবে না। ছোট্ট একটা মামলা দিয়ে দিই, আদালতে গেলেই জামিন হবে। পরদিন ২৮ জানুয়ারি শনিবার প্রতারণার একটি মামলা দিয়ে আদালতে চালান করে। আদালতে গিয়ে আমরা উকিল ধরে জামিন নিয়ে ওই দিন বিকালে বাসায় আসি।
মোক্তারের বন্ধু ও মসলা ব্যবসায়ী আজিজুল হক ইকবাল জানান, ২৭ জানুয়ারি জুমার নামাজের পর মোক্তারের স্ত্রী যখন আমার বাসায় আসে তখন আমি জানতে পারি, মোক্তারকে পুলিশ আটক করেছে। মোক্তার এর আগে আমার একটি বড় উপকার করেছিলেন। তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমি মোক্তারের মুক্তির জন্য তার স্ত্রীকে ১৫ লাখ টাকা দিই। ওই টাকা তিনি এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।
এসআই অলিউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে ওসি স্যার মোক্তারের বাসায় পাঠিয়েছিলেন চায়ের দাওয়াত দিতে। আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। পরে তাকে নিয়ে একসঙ্গে থানায় আসি। এরপর কী হয়েছে বলতে পারব না।
মামলার বাদী আমিনুল হক মুরাদ বলেন, গত ১৮ জানুয়ারি ট্রাকে মালামাল লোড করার সময় দেখতে পাই পণ্যসামগ্রীর মধ্যে জিপিএস ট্র্যাকার লাগানো আছে। পরে জানা যায়, লেবার সেলিমকে দিয়ে ওই ট্র্যাকার লাগিয়েছে মোক্তার হোসেন। এরপর ২৬ জানুয়ারি রাতে পুলিশ মোক্তারকে তার বাসা থেকে আটক করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার এসআই মামুন হোসেন বলেন, ঘটনার বিষয়ে এজাহারে যা আছে এর চেয়ে বেশি বলতে পারব না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা হলেও আসামিকে আমি গ্রেফতার করিনি। তাই তাকে কোথা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে এজাহারে আছে চকবাজারের ইমামগঞ্জ এলাকার মহিউদ্দিন লেন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনাটি নিয়ে চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইউম ও ইমামগঞ্জ রহমানিয়া ট্রান্সপোর্টের মালিক আমিনুল ইসলাম মুরাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদরদপ্তরে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী পরিবহন ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন৷