একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যদি তার নিরাপত্তার কথা ভাবে, সেটি কি অপরাধ? প্রতিবেশি রাষ্ট্র যখন প্রতিনিয়ত আক্রমণের হুমকি দেয়, বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে, তখন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো বিলাসিতা নয়—এটা রাষ্ট্রের অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই অধিকার শুধু কিছু নির্দিষ্ট দেশের জন্যই যেন বৈধ। বিশ্বশক্তির নামে পরিচিত জি-সেভেন (G7) গোষ্ঠীর আচরণ এ প্রশ্নটিই উসকে দেয় বারবার।
জি-সেভেন—বিশ্বের সাতটি প্রভাবশালী ও ধনী দেশের একজোট। এই সাতটি দেশ হলো: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও কানাডা। এই তালিকার প্রথম তিনটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স, নিজেরাই পরমাণু অস্ত্রের মালিক।
জার্মানি ও ইতালি, মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র হোস্ট করে, প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহারও করতে পারে। জাপান ও কানাডা, যদিও পরমাণু অস্ত্রহীন অবস্থান বজায় রেখেছে, তবু নিরাপত্তা জোটে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
অথচ, এই দেশগুলোর জোট—জি-সেভেন সম্প্রতি বলেছে, আমরা একমত এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—ইরান যেন কখনও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন না করতে পারে।
তাদের এমন বক্তব্য যেন প্রশ্ন তোলে: তাহলে কি পরমাণু অধিকার কেবল তাদের জন্যই সংরক্ষিত?
ইরানের ওপর ইসরায়েল যখন একের পর এক ড্রোন হামলা চালায়, হত্যা করে পরমাণু বিজ্ঞানী ও সামরিক কমান্ডারদের—তখন জি-সেভেনের কোনো নিন্দা ছিল না। ইরান যখন তার সার্বভৌম অধিকারের মধ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণু কর্মসূচি চালায়, তখন সেটাই হয়ে যায় হুমকি!
তারা তখন বলে, ইরানের এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ ইসরায়েল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, কারও কাছে জবাবদিহিতাও নেই।
জি-সেভেন এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং আমরা তা নিশ্চিত করেই যাব।
এই আত্মরক্ষার তলে তারা জায়েজ করে দিচ্ছে হত্যা, নিপীড়ন ও একতরফা আগ্রাসনকে। আর ইরানের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হয়ে যাচ্ছে অবৈধ! যে নীতিতে একজন মুক্ত—অন্যজন দমনযোগ্য, সেটি আর নীতি নয়—ভণ্ডামি।
জি-সেভেনের ভাষায় শান্তির কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে সেটি নির্দিষ্ট পক্ষের সুবিধার কথামাত্র।
একই বিবৃতিতে তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথাও বলেছে। তারা চায়, আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হোক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই আলোচনার টেবিলে কি ন্যায়বিচার থাকবে?বিশ্বের বহু দেশ পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনা করছে। কিন্তু মুসলিম দেশ হলেই তা হয়ে যায় আন্তর্জাতিক হুমকি! ইরানের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান যেন এক অদৃশ্য ইসলামোফোবিয়ার বহিঃপ্রকাশ। যা বিশ্বশান্তি নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির পক্ষপাতদুষ্ট চেহারা প্রকাশ করে।
জি-সেভেনের বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা চাই, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু শান্তি তো পক্ষপাত দিয়ে আসে না, শান্তি আসে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা দিয়ে। যেখানে সব রাষ্ট্রের সমান অধিকার থাকে—ভয় কিংবা পছন্দের ওপর নয়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এবং মন্ত্রীদের কয়েকদিনের বক্তব্য শুনলে বুঝা যায়, তারা যুদ্ধ চায় না। তারা চায় নিরাপত্তা। তারা চায় প্রতিরক্ষা। যেটা অন্য দেশ করলে বৈধ, সেটাই ইরান করলে অবৈধ—এই দ্বিচারিতা আর কতদিন চলবে?
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো যদি ন্যায়ের ভারসাম্য না রাখে, তাহলে যুদ্ধ থামবে না—শুধু অন্য নামে চলতে থাকবে। আর ইতিহাস বলবে, একসময়ে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কথা বলারাই, তার সবচেয়ে বড় ধ্বংসযন্ত্র হাতে রেখেছিল।