বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

জুলাই বিপ্লবে প্রথম হামলার শিকার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ছিল সেই দিনগুলো

-বিজ্ঞাপণ-spot_img
- বিজ্ঞাপণ-

জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি দিনে দিনে হয়তো ভুলতে শুরু করেছে ছাত্র-জনতা। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার পতনের দাবিতে চলা এই বিপ্লব সারাদেশের শিক্ষার্থীদের এক করে তুলেছিল। দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের আরেক প্রাণ ভোমরা। ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’— সব কর্মসূচিতে সক্রীয় ছিল দেশের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমের ক্যাম্পাসটি ছিল, জুলাই আন্দোলনের ফোঁড়ন।

১১ জুলাই ২০২৪। সেদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্বরোড অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে পদযাত্রা শুরু করে শিক্ষার্থীরা। কিছুদূর যেতে না যেতেই শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। মুহূর্মুহূ গুলি ও টিয়ারশেলের আঘাতে আহত হন সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা। কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা কোটবাড়ি বিশ্বরোডের দিকে রওনা হয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের কর্মসূচি পালন করতে চান তারা। এরপরও পুলিশ তাদের বাধা দিলে, এর জবাব দেওয়া হবে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে পুলিশ পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

একই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্দোলন চলতে থাকে স্বৈরাচার পতনের দিন পর্যন্ত। এরইমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকরতম দিন ছিল ১৮ জুলাই। সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছিল কুবিসহ কুমিল্লার অন্যান্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ও টিয়ারশেল ছুঁড়তে থাকে পুলিশ-বিজিবি। একপর্যায়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে হাসপাতালে নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।

কুমিল্লা মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব মুহাম্মাদ রাশেদুল হাসান বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু ঢাবিতে হলেও প্রথম হামলার শিকার হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। হামলার প্রতিক্রিয়ায় ১২ জুলাই সারাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস ‘কুবিতে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’— স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে। কোটা সংস্কার থেকে আন্দোলন রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের এক দফা দাবিতে। ৩ আগস্ট একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে কুমিল্লায় নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্রলীগ। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের আহ্বান জানানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। জবাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শিক্ষার্থীরা জানায়— একদিকে আপনারা আমাদের আলোচনার টেবিলে বসতে বলছেন, অন্যদিকে কুমিল্লায় আমাদের বোনদের রক্ত ঝারাচ্ছেন!

অবশ্য রাশেদুল হাসানের বক্তব্যের সত্যতা মিলে সেদিন ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের আর্তনাদের একটি ভিডিওতে। ছোট সেই ক্লিপটিতে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে আক্রমণের শিকার নারী শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা যায়, আংকেল গেটটা একটু খোলেন, একটু খুলেন না প্লিজ আংকেল। কিন্তু কিছুতেই যেন মন গলেনি বাড়িওয়ালা সেই ব্যক্তির।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সায়েদুল ইসলাম নামের এক কুবি শিক্ষার্থী বলেন, সেই স্মৃতি আজও যেন চোখে ভাসছে, দুঃসহ যন্ত্রণার মতো। ৩৬ জুলাইয়ে রক্তিম সূর্যোদয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিল, বৈষম্য ও প্রহসনের বিরুদ্ধে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো। আন্দোলনের দিনগুলোতে ছাত্রলীগ এবং অতি উৎসাহী প্রশাসনের হামলাকে উপেক্ষা করে, আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি। পৈশাচিক সব হামলার মধ্যেও, আমাদের বজ্রকণ্ঠ স্লোগানের সামনে টিকতে পারেনি স্বৈরাচারের লাঠিয়াল বাহিনীরা। স্লোগানে স্লোগানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাজপথ কাঁপিয়েছি আমরাও। তবুও আমরা আজ আন্ডাররেটেড।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, সারাদেশের ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন ও অকাতরে জীবন দানের একপর্যায়ে ৫ আগস্ট পতন হয়, আওয়ামী স্বৈরাচারের। দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো ব্যক্তি হিসেবে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার আগে, ছাত্র-জনতার পাশাপাশি কেড়ে নেয় অনেক সাংবাদিকের জীবন। যা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি।

নুর মোহাম্মদ রাজু, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। আহতদের চিকিৎসা থেকে আটকদের ছাড়ানো— আন্দোলনের প্রতি মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা এই শিক্ষক বলেন, জুলাই আন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, সুবিশাল পাহাড়ের মতো। বুক পেতে গুলি নিয়েছে তবুও পিছু হটেনি। এ আন্দোলনে আমাদের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন। কয়েকজন শিক্ষক মানববন্ধন করেছেন। আন্দোলনে আটক শিক্ষার্থীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। এছাড়া আমাদের অ্যালামনাইরা আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন।

- Advertisement -

কুবির এই শিক্ষক আরও বলেন, জুলাই আন্দোলনে আমাদের এক শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। শহীদ আব্দুল কাইয়ুম। তিনি অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। এটা আমাদের জন্য বড় একটি অর্জনের পাশাপাশি শোকেরও ব্যাপার। শহীদ কাইয়ুমের প্রেরণা সব সময় আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে, বিভিন্ন আন্দোলনে, সংগ্রামে।

যদিও জুলাই বিপ্লবের পর সেভাবে আলোচনা হয়নি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে। ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কুবিয়ানদের সাহসিকতা বিপ্লবের পর যথাযথ মর্যাদা ও কৃতিত্ব পায়নি- মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা।

শেয়ার করুন
- Advertisement -

সর্বশেষ নিউজ

বিরোধী পক্ষের লাশ দেখলে খুশি হতেন হাসিনা: রিজভী

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেই বাদী হয়ে মামলা করা উচিত। বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে...

চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে সচিবালয়ে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে তারা আবারও আন্দোলনে নেমেছেন। বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তারা একটি...

পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন উপদেষ্টা নাহিদ-আসিফ

রাজনৈতিক পালাবদল চলছে বাংলাদেশে। এ প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার নতুন একটি রাজনৈতিক দল দ্রুতই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দল ঘোষণার...

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে দ্রুত বিচার কার্যকর করুন: হাসনাত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে দ্রুত দলটির নেতাকর্মীদের বিচার করতে হবে। বুধবার (২৯ জানুয়ারি)রাত ১০টা ২৫...

সম্পর্কিত নিউজ

বিরোধী পক্ষের লাশ দেখলে খুশি হতেন হাসিনা: রিজভী

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধীদের বিরুদ্ধে...

চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে সচিবালয়ে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে তারা আবারও...

পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন উপদেষ্টা নাহিদ-আসিফ

রাজনৈতিক পালাবদল চলছে বাংলাদেশে। এ প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার নতুন একটি রাজনৈতিক...