মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তাপ আরও বেড়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকের কারণে। ১৭ এপ্রিল, ইরানের রাজধানী তেহরানে প্রেসিডেন্সিয়াল কম্পাউন্ডে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সৌদি আরব ইরানকে একটি স্পষ্ট ও কঠোর বার্তা দিয়েছে—ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে আসতে হবে, না হলে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের মুখে পড়তে হতে পারে।
এই বার্তা পৌঁছে দেন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান, যিনি সৌদি বাদশাহ ও তার পিতা সালমান বিন আব্দুল আজিজের সরাসরি নির্দেশে এই দায়িত্ব পালন করেন। রয়টার্স জানিয়েছে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাগেরি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি।
বৈঠকে প্রিন্স খালিদ স্পষ্ট করে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘ মেয়াদি আলোচনায় আগ্রহী নয়। কূটনৈতিক দরজা দ্রুত বন্ধ হয়ে যেতে পারে,—এমন সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি জানান, আলোচনায় না এলে ইরানকে ইসরায়েলি হামলার ঝুঁকি বিবেচনায় রাখতে হবে। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে অনেক বেশি যৌক্তিক।
এই গোপন বার্তার প্রেক্ষাপট আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ এর ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, তার প্রশাসন তেহরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে। এই আলোচনার উদ্দেশ্য, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি রোধ এবং আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা। ট্রাম্পের ঘোষণার সময় তার পাশে ছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি বরাবরই ইরানবিরোধী অবস্থানে আছেন এবং ওয়াশিংটনের সমর্থন প্রত্যাশা করছেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বৈঠকে জানান, তারা একটি কার্যকর ও অর্থনৈতিক চাপ লাঘবকারী চুক্তিতে আগ্রহী। তবে ইরানি প্রতিনিধিরা ট্রাম্প প্রশাসনের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বিশেষ করে তার অপ্রত্যাশিত ও পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে। তাদের মতে, মার্কিন অবস্থান বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে—কখনো সীমিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ মেনে নেয়, আবার কখনো পুরো কর্মসূচি বন্ধের দাবি তোলে।
রয়টার্স জানিয়েছে, আলোচনার পর ইরান একটি প্রস্তাব দেয়, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আটকে রাখা তহবিল মুক্ত করার এবং শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির স্বীকৃতির বিনিময়ে সাময়িকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থগিত করতে রাজি হয়। তবে পরে ইরান এই খবর অস্বীকার করে।
সৌদি বার্তায় শুধু চুক্তি নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কৌশলের দিকটিও গুরুত্ব পেয়েছে। প্রিন্স খালিদ বৈঠকে ২০১৯ সালের সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, আরেকটি যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। কারণ সংঘাত আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বৈঠকের শেষদিকে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইরানকে আশ্বস্ত করেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল যদি হামলা চালায়, তবে সৌদি আরব তাদের ভূখণ্ড বা আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না।
চীনের মধ্যস্থতায় ২০২৩ সালে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও, পারস্পরিক অবিশ্বাস এখনো দৃঢ়। এবার তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ট্রাম্পের নতুন কূটনৈতিক কৌশল—যা দ্রুত সিদ্ধান্ত, চাপ প্রয়োগ ও অনিশ্চয়তার এক বিস্ময়কর মিশ্রণ তৈরি করেছে।