রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫

ধর্ষণ রোধে ইসলামের ভূমিকা

তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
-বিজ্ঞাপণ-spot_img

সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও বিভীষিকাময় অপরাধগুলোর মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। এটি শুধু একজন নারীর ইজ্জত ও মর্যাদাকে কলুষিত করে না, বরং পুরো সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও নৈতিকতার সর্বোচ্চ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে। তাই ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ রোধে ইসলাম কঠোর শাস্তির বিধান করেছে, পাশাপাশি এমন সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে, যাতে এই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাই কমে যায়।

ইসলামের দৃষ্টিতে, ধর্ষণ শুধু শরীরের ওপর জুলুম নয়, এটি আত্মা ও মানসিকতার ওপর এক ভয়ংকর আঘাত। তাই ইসলাম ধর্ষণের শাস্তিকে ব্যভিচারের সাধারণ শাস্তির চেয়েও কঠোর করেছে। একই সঙ্গে, এই অপরাধের পথ বন্ধ করতে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য শালীনতা, পর্দা, ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। ইসলাম চায় এমন এক সমাজ, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই নিরাপদ ও সম্মানিত জীবন যাপন করতে পারে, যেখানে নারীর সম্ভ্রম শুধুই আইনের নয়, বরং গোটা সমাজের সম্মানের প্রতীক হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণের শাস্তি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।


১. কঠোর শাস্তির বিধান


ইসলামে ধর্ষণকে ব্যভিচারের চেয়েও গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ—তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো।” (সূরা নূর: ২)
কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরও কঠোর শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি জোরপূর্বক (ধর্ষণের মাধ্যমে) কারো ইজ্জত লুটে নেয়, তাকে হত্যা করা হবে।” (তিরমিজি-১৪৫৪)
খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে এক ধর্ষকের বিরুদ্ধে চার সাক্ষী না থাকলেও তার অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে ধর্ষকের জন্য কঠোরতম শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।


২. পর্দার বিধান: সম্ভ্রম রক্ষার দেয়াল


ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শালীন পোশাক ও চরিত্র বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
“মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে যা সাধারণত প্রকাশিত হয় তা ছাড়া।” (সূরা নূর: ৩১)
এছাড়া, পুরুষদেরও সতর্ক করা হয়েছে:
“মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য পবিত্রতা রয়েছে।” (সূরা নূর: ৩০)


পর্দার এই বিধান কেবল নারীর জন্য নয়, বরং পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য। এর ফলে সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ কমে যায় এবং ধর্ষণের সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।


৩. অবৈধ সম্পর্কের প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা


ইসলাম ব্যভিচারের শুধু শাস্তি নির্ধারণ করেনি, বরং সেই দিকে নিয়ে যায় এমন সব পথ ও মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ এবং খুবই মন্দ পথ।” (সূরা ইসরা: ৩২)
এ কারণে, ইসলাম বিজাতীয় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করেছে এবং সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার ওপর জোর দিয়েছে।


৪. ন্যায়বিচার ও নারীর সম্মান নিশ্চিতকরণ


ইসলাম নারীকে ভোগ্যবস্তু নয়, বরং সম্মানিত ও মর্যাদাশীল এক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। হাদিসে এসেছে:
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের প্রতি সর্বোত্তম।” (তিরমিজি-৩৮৯৫)
ইসলামে নারীর অধিকার যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি নারীকে সম্ভ্রমের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


৫. মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে শাস্তি


ইসলাম মিথ্যা অপবাদ ও গুজব ছড়ানোকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআনে এসেছে:
“যারা সতী-সাধ্বী নারীদের ওপর অপবাদ দেয় এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদের আশি বেত্রাঘাত করো এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না।” (সূরা নূর: ৪)
এতে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি মিথ্যা অভিযোগ দাতাদের প্রতিও কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।


ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলাম শুধু শাস্তিই নির্ধারণ করেনি, বরং পুরো সমাজব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে ধর্ষণের মতো অপরাধের উদ্ভবই না ঘটে। ইসলাম পর্দা, নৈতিকতা, সামাজিক শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ও কঠোর শাস্তির সমন্বয়ে এমন একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে চায়, যেখানে নারীরা সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারে এবং ধর্ষণের মতো পাশবিকতা সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যায়। “যদি সমাজ ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলে, তবে ধর্ষণ রোধ করা শুধু সম্ভব নয়, বরং অপরাধী মনোবৃত্তির জন্মই হতে পারবে না।” আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামী হুকুম মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।


লেখক: তাওহীদ আদনান ইয়াকুব

ফাযেল, দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে এক চুক্তি, ৪টি স্মারক ও একটি কর্মসূচি সই

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি,...

কাদা ছোড়াছুড়ি না করে ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহবান সাদিক কায়েমের

ঢাবি প্রতিনিধিডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সকল প্রার্থীকে ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী...

ইকসু গঠনে এক প্লাটফর্মে ইবির সকল শিক্ষার্থী 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলো কুষ্টিয়ার  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। কিন্তু দীর্ঘ ৪৫ বছরেও গঠিত হয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। তবে সম্প্রতি এ নিয়ে সরব...

স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ববিতে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বাংলাদেশের সকল সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছে শিক্ষার্থীরা।শনিবার...

সম্পর্কিত নিউজ

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে এক চুক্তি, ৪টি স্মারক ও একটি কর্মসূচি সই

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী...

কাদা ছোড়াছুড়ি না করে ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহবান সাদিক কায়েমের

ঢাবি প্রতিনিধিডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সকল...

ইকসু গঠনে এক প্লাটফর্মে ইবির সকল শিক্ষার্থী 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলো কুষ্টিয়ার  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। কিন্তু দীর্ঘ ৪৫ বছরেও...