নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার পাশাপাশি নারী প্রতিনিধিত্ব ১০০ আসনে উন্নীত করার প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল একমত হলেও সরাসরি নির্বাচনের ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে সুজনের পক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়, সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ না দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির আধিপত্য বজায় রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর সিরডাপের এটিএম শামসুল হক মিলনায়তনে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কর্তৃক আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপের মূল প্রবন্ধে এসব উঠে আসে।
সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন—জাতীয় কমিটির সদস্য মো. একরাম হোসেন।
তিনি জানান, দেশের ৬৪ জেলায় ১৫টি নাগরিক সংলাপ ও বিস্তৃত জনমত জরিপের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সনদের খসড়া তৈরি হয়। পরে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক শেষে ২০২৫ সালের জুলাই সংস্করণটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে মোট ৯৫টি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৮৪টিতে সর্বসম্মত সমর্থন মিলেছে এবং ১১টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।
সংলাপে জানানো হয়, সনদে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং উচ্চ আদালতের শাখা বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপনের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষ নিয়োগ নিশ্চিত করতে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া চালুর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালনের সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তির থাকা যাবে না বলেও সনদে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থায় আনা হয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব। সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে একটি উচ্চকক্ষ গঠন এবং বর্তমান একক সদস্যভিত্তিক আসনের পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও এসেছে সনদে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব আনা হলেও তা বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়নি। প্রস্তাব ছিল—রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করে সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ভোটাধিকার দেওয়া। এছাড়া সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) বাতিল করাকে ‘যুগান্তকারী সুযোগ হারানো’ হিসেবে আখ্যা দেন বক্তারা।
সংলাপে প্রস্তাবিত সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়। সুজনের পক্ষ থেকে চারটি বিকল্প পথ প্রস্তাব করা হয়, সংবিধান সংশোধন, গণভোট, রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন এবং নতুন করে গণপরিষদ গঠন। যেকোনো সনদের সাফল্য নির্ভর করে তার বাস্তবায়নের ওপর। তাই আমরা শুধু প্রস্তাব দিয়েই থেমে থাকিনি, বাস্তবায়নের রোডম্যাপও তুলে ধরেছি।
সুজন জানিয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সনদের প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করা হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে যাওয়া হবে। দেশের মানুষ যে পরিবর্তন চায়, তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
দীর্ঘদিনের আলোচনা, জেলা পর্যায়ের সংলাপ ও জনমত জরিপের পর সনদের খসড়া চূড়ান্ত হয়। এতে বিচার বিভাগ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।