সাজ্জাদ শরিফ
শুরু হলো ভাষার মাস। এ মাস নানা মাত্রিকতায় উদযাপিত হলেও বইমেলাকে কেন্দ্র করে পাঠকের মাঝে নতুন করে পড়াশোনার এক আবহ তৈরি হয়। নতুন বইয়ের নতুন নতুন গন্ধে বিমোহিত হলেও পড়ার আবেগ আজকের তারুণ্যকে ‘পড়া’র প্রতি প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। অথচ আজকের প্রজন্মের বিরাট এক অংশ জানেই না যে, পড়াশোনার প্রকৃত মাহাত্ম্য কী!
মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান অর্জনের উপযোগী করেই সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কুরআনের প্রথম নির্দেশ- পড়। দ্বিতীয় নির্দেশও পড়। মুসলিম উম্মাহর পরিচয়ই হলো, ‘পড়ুয়া জাতি’। এ জাতি যাত্রার সূচনাই হয়েছে এ নির্দেশের মাধ্যমে- পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানব আলাক হতে। পড়ো তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিখিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত: ১-৫)।
জাবালে নুরের হেরা গুহায় মানব ও মানবতার মুক্তি ও কল্যাণচিন্তায় ধ্যানমগ্ন ও বিভোর ছিলেন প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা.। এসময় তাঁর কাছে প্রথম প্রত্যাদেশের প্রথম নির্দেশই ছিলো ‘ইকরা-পড়ো’।ফেরেশতাকুলের সরদার হজরত জিবরাইল আ. আল্লাহর নির্দেশে এসে বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ প্রিয় নবীজি সা. বললেন, ‘মা আনা বিকারিয়িন—আমি পাঠক নই।’ জিবরাইল আ. নবীজির সঙ্গে গভীর আলিঙ্গন করলেন এবং আবার বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ নবীজি সা. এবারও বললেন, ‘মা আনা বিকারিয়িন—আমি পাঠক নই।’ জিবরাইল আ. আবারও নবীর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করলেন এবং পুনরায় বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ নবীজি সা. এবার বললেন, ‘মা যা আকরাউ—কী পড়ব আমি?’ তখন হজরত জিবরাইল আ. একটি সবুজ রুমালে
সোনালি বর্ণে লেখা দেখিয়ে সুরা আলাক-এর উপরিউক্ত প্রথম পাঁচ আয়াত পাঠ করলেন। জিবরাইল আ.-এর সঙ্গে সঙ্গে রাসুল সা.ও পড়লেন। সেদিন আরবের হেরাগুহার সেই আলো নিয়ে রাসুল সা. নেমে এলেন মানব ও মানবসভ্যতার কাছে। শোনালেন নতুন বাণী। মুক্তি ও সফলতা লাভের নতুন পয়গাম। সেদিন থেকেই ইকরা’র মিশন নিয়ে নতুনভাবে শুরু হলো এক জাগ্রত জাতির নব-অভিযাত্রা।
নবী কারিম সা.জীবনভর মানুষকে জ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এমনকি বদর যুদ্ধে বন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে। জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনায় নবীজি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ : ২২৪)। জ্ঞানের মাধ্যমে নবীজি একটি পিছিয়ে পড় বর্বর জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন।
আধুনিক বিশ্বের এ যুগে পড়াশোনার সহজ মাধ্যম হলো ‘বই’। বর্তমানে পড়াশোনার জন্য বইয়ের গুরুত্বও অপরিসীম। এ বই পড়ার মাধ্যমেই ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতিসহ নানান বিষয়ে যেমন জ্ঞান অর্জন করতে পারি ; তেমনি নিজেদের সমৃদ্ধ করে তুলতে। ১৯৮৩ সালে শুরু হওয়া বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুতোষ ও গবেষণাসহ নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যে বিন্যস্ত গ্রন্থমেলার গ্রন্থাবলি। মেলার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা, বই কেনা আর উপচেপড়া ভিড় প্রকারান্তরে এই মেলাকে আজ বাঙালির এক অন্যতম উৎসবে রূপান্তরিত করেছে। আর এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হলো বই অর্থাৎ বইকে আবর্তিত করেই গড়ে উঠেছে এই মিলন মেলা; যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গ্রন্থের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বই ও মেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের এই উৎসাহ উদ্দীপনাকে আলোকিত করতে হবে নববি বিভার আলোকরেখায়। আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে যে আলোর অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পড়াশোনা না করে একজন ভালো মুসলিম হওয়াও কোনোভাবে সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর আজকের এ সমৃদ্ধির কারণ খুঁজলেই পাওয়া যাবে, জ্ঞান অর্জনে তাদের গভীর মনোনিবেশ। অপরদিকে মুসলিম উম্মাহর এ দুর্দশার কারণ জ্ঞান অর্জনে বিমুখতা। মুসলিম উম্মাহের হারানো গৌরব ফিরে পেতে হলে মুসলমানদের আবার জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমরা ফিরে পাবো হারানো সম্মান, হারানো ঐতিহ্য।