বিশ্বে সাধারণত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আন্দোলনের ঘটনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প রূপপুরে সেই ইতিহাস ভাঙল। বিভিন্ন দাবিতে কর্মীরা আন্দোলন করছেন। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ।
কোনো পরিষ্কার কারণ ছাড়াই ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত এবং ৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এর ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায়নি। রূপপুর একটি স্পর্শকাতর প্রকল্প। এখানে ছেলেখেলার সুযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতেও বড় ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
১৫ জন প্রকৌশলীকে কোনো কারণ ছাড়া চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)। তারা বলছে, প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। আইইবি তাদের স্বপদে পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছে।
অনেকবার সময়সীমা পেছানোর পর আগামী ডিসেম্বরেই ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট চালুর কথা। কিন্তু কেন্দ্র চালুর আগেই কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এতে রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং অন্য বিদেশি অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এই প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম চলে আসছে। অনেকেই এর পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছেন। তবে এ বিষয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (NPCBL)-এর চেয়ারম্যান, মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রূপপুরে নির্মাণাধীন প্রকল্পের কর্মীরা কিছুদিন ধরেই আন্দোলনে আছেন। এনপিসিবিএল তাদের বিভিন্ন সময় ৩০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে এবং ২৬ জনকে প্রকল্পে প্রবেশ করতে দেয়নি। এরপর ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
চাকরিচ্যুত কর্মীদের অব্যাহতিপত্রে বলা হয়েছে, “এনপিসিবিএলে আপনার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই।”
প্রতিজনের পেছনে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলে ১৮ জনের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই অপচয়ের দায় কে নেবে? কর্মীদের মধ্যেও আতঙ্ক এবং অসন্তোষ বাড়ছে।
২০১৫ সালে এনপিসিবিএল যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এতদিনেও তারা কোনো ‘সার্ভিস রুল’ প্রণয়ন করতে পারেনি। কর্মীরা সেই সার্ভিস রুল, প্রশিক্ষণ ভাতা, পদোন্নতি, পরিবহন সুবিধা, মেডিকেল ভাতা এবং কর্মপরিবেশের দাবি করে আসছিলেন।
তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ এসব দাবি আমলে নেয়নি। বরং তাদের হয়রানি করেছে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর কর্মীদের দাবি আরও জোরালো হয়। এরপর প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাসান লিখিতভাবে কিছু দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন ৫ সেপ্টেম্বর।
কিন্তু সেই আশ্বাস পূরণ না হওয়ায় আন্দোলনে নামে কর্মীরা। তারা প্রকল্প এলাকায় বিক্ষোভ করে, সংবাদ সম্মেলন করে এবং বিবৃতি দেয়।
আন্দোলনের সময় ৫ মে সার্ভিস রুল অনুমোদন করে বোর্ড। ৮ মে ১৮ জন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে এবং পরে ৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
চাকরিচ্যুত কর্মীরা বলছেন, তারা চুক্তিভিত্তিক কর্মী নন। অনেকেই ৫-৭ বছর ধরে চাকরি করছেন এবং চাকরি স্থায়ী হয়েছে। তাদের নিয়োগপত্রে বলা আছে, অন্তত ১০ বছর চাকরি করতে হবে। এখন হঠাৎ করেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এক ভুক্তভোগী জানান, তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি। অব্যাহতিপত্রে কোনো বিশৃঙ্খলার অভিযোগও নেই। শুধু বলা হয়েছে, সার্ভিসের প্রয়োজন নেই। এটি অন্যায়।
সহকারী ব্যবস্থাপক আসিফ খান জানান, তিনি ছয় বছর ধরে কাজ করছেন। বিদেশ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কোনো নোটিশ ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা দেশসেবার জন্য এখানে কাজ করেছি। এখন চাকরিতে ফিরে যেতে চাই।”
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এখানে আড়াই হাজার পদের বিপরীতে ১,৮০০ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজারজনের বেশি রাশিয়ায় এবং বাকিরা দেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ গড়ে প্রতিজনের পেছনে ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কেউ চাকরি ছাড়লে সেই অর্থ ফেরত দিতে হয়।
২০২০ সালের ৫ নভেম্বর ঊর্মি দেবনাথ নামে এক কর্মী চাকরি ছাড়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তার কাছে ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা দাবি করে।
কর্মীদের অভিযোগ, প্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাসান একাই ছয়টি পদ দখল করে আছেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, প্রধান অর্থ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এবং স্টেশন ডিরেক্টর। এর ফলে তিনি স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্পে স্বচ্ছতা নেই। শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের বাদ দিয়ে সব করা হয়েছে। এর ফলে বৈষম্য ও একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন সার্ভিস রুল ছিল না। হঠাৎ তা অনুমোদন দিয়ে ১৮ জনকে বরখাস্ত করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর দায় বোর্ড চেয়ারম্যানের, যিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব।”
তিনি আরও বলেন, “আন্দোলন চলাকালে কোনো আলোচনার চেষ্টা করা হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটি নির্মাণকাজের জন্য হুমকি। ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।”
তিনি যোগ করেন, “পারমাণবিক প্রকল্পে আন্দোলন করা ঠিক নয়। কিন্তু কর্মীরা কেন আন্দোলন করছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার।”
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রকল্পে নিরাপত্তার স্বার্থে আন্দোলনের সুযোগ নেই। তবে কর্তৃপক্ষেরও উচিত কর্মীদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা।
তিনি বলেন, “এখানে মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা (কমিউনিকেশন গ্যাপ) আছে। এটা দ্রুত দূর করা দরকার।”
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য না পাওয়া: প্রকল্প পরিচালক জাহেদুল হাসানকে ৭ মে ফোন করে সাক্ষাতের সময় চাইলে তিনি পরদিন অফিসে যেতে বলেন। পরদিনও সাক্ষাৎ মেলেনি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন এনপিসিবিএলের চেয়ারম্যান। তার অফিসে তিন দিন যাওয়া হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন করেও সাড়া মেলেনি।
সতর্কতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ: ৬ মে এক ইমেইলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সতর্ক করে বলা হয়, রূপপুর একটি ‘১ক’ শ্রেণিভুক্ত কেপিআই (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা)। তাই শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। এই বার্তা পাঠান এনপিসিবিএলের সচিব এস আব্দুর রশিদ।