হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রজগৎ তার সাহিত্যজগতেরই এক সম্প্রসারণ। তিনি যেভাবে উপন্যাসে পাঠককে গল্পের মধ্যে টেনে নেন, ঠিক তেমনি ভাবে সিনেমার দৃশ্যপটেও আকড়ে ধরে রাখেন দর্শকদের।
তার চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, সময়, সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের জটিল মনোজগতের প্রতিচ্ছবি। চোখের দেখায় তিনি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি আজও জীবন্ত।
হুমায়ূন আহমেদ তার জীবদ্দশায় মোট ৮টি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্য থেকে দর্শকপ্রিয়তা, পুরস্কার ও সমালোচকদের প্রশংসায় এগিয়ে থাকা ৫টি সিনেমা কথা তুলে ধরা হলো-
‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র হলেও, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ, পরিপক্ব কাজ। এ ছবিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আবহে একটি সাধারণ পরিবারের প্রতিদিনের জীবন, ভালোবাসা, ভয় ও সাহস ফুটে উঠেছে অসাধারণ মানবিকতায়। আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, ডলি জহুর, শিলা আহমেদের অভিনয় দর্শকের হৃদয়ে ছাপ রেখে গেছে। এই চলচ্চিত্রে দেশপ্রেমের গল্প একদম ঘরের ভেতর থেকে বলা হয়েছে যা বহু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির চেয়ে আলাদা, আন্তরিক।
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯)
একটি নিঃশব্দ গ্রামে বসে যে প্রেম জন্ম নেয়, তার আলো-অন্ধকার, ক্লান্তি ও কাঙালতা- সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সেরা রোমান্টিক সিনেমা এটি। যদিও এখানে জমিদারি শাসনের করুণ চিত্র, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীর আত্ম অনুশোচনার গল্পও ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। ছবিতে জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের আবেগময় অভিনয় আজও দর্শকমনকে আন্দোলিত করে। সংলাপ, অভিনয়ের মুন্সিয়ানা যেমন এই সিনেমাকে অনন্য করেছে তেমনি বারী সিদ্দিকী, সুবীর নন্দীদের কণ্ঠে উকিল মুন্সি ও হুমায়ূন আহমেদের লেখা গানগুলোও সিনেমাটিকে কালজয়ী করেছে।
‘দুই দুয়ারী’ (২০০০)
সম্পূর্ণ পারিবারিক এই ছবিটিতে পরিচালক তুলে ধরেছেন একজন রহস্য মানবের মন ভালো করার কিছু রহস্যের ঘটনা। ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন জনপ্রিয় অভিনেতা রিয়াজ। এই ছবিতে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন এই নায়ক। অন্য প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাওন ও মাহফুজ আহমেদ। হাসি ও রোমান্টিকতার আড়ালে এই সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে রহস্যময় জীবনের জটিল সমস্যাগুলোকে সহজভাবে সমাধানের ও গ্রহণের মানসিকতাকে। ছবিটি গল্প, নির্মাণে ঢালিউডে এক অনন্য সংযোজন।
‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩)
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩) একটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি। এই সিনেমাটি কোনো একরৈখিক বা সোজাসাপ্টা গল্প বলার প্রচেষ্টা নয়, বরং এটি একটি চিত্রকল্পে মোড়ানো আবেগময় কাব্যচিত্র। এখানে গ্রাম বাংলার মানুষ, প্রেম, মাটি, সুর ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আবার শক্তি হারিয়ে ফেলা জমিদারি প্রথার তথাকথিত দম্ভ, লালসার চিত্রও ফুটে উঠেছে ছবিটিতে। এতে জমিদার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। আরও আছেন মেহের আফরোজ শাওন, ফেরদৌস আহমেদ প্রমুখ। ছবিতে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ গানটিও অসাধারণ এক সৃষ্টি।
‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪)
এ ছবি দিয়ে মোটা দাগে দ্বিতীয়বারের মতো হুমায়ূন আহমেদ ফিরে এলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তবে এবার বড় পরিসরে, আরও বেশি বাস্তবতার ছোঁয়ায়। ‘শ্যামল ছায়া’ শুধু যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের সময় মানুষের মনোজগৎ, টানাপোড়েন, দ্বিধা এবং শেষমেশ আত্মত্যাগকে গভীরভাবে তুলে ধরেছে। এই সিনেমা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্কারে ‘Best Foreign Language Film’ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। ছবিটিতে হুমায়ূন ফরীদি, রিয়াজ, মেহের আফরোজ শাওন, শিমুল, ডা, এজাজসহ একঝাঁক তারকা অভিনয়ের মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন।
এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেছেন ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘আমার আছে জল’ এবং ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ নামের তিনটি সিনেমা।