আব্দুল্লাহ আল আলীম, দেবীদ্বার(কুমিল্লা) প্রতিনিধি: কুমিল্লার দেবীদ্বারে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনার পর গ্রেফতার আতঙ্কে আজ বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে আসেনি কোন শিক্ষার্থী। রাতে পুলিশি অভিযানের পর থেকে পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। স্থানীয় মাশিকাড়া বাজারে অধিকাংশ দোকান পাঠও বন্ধ রয়েছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে ১০জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় খোয়া যাওয়া পুলিশের শর্টগানটি উদ্ধার করা হয়েছে।
এর আগে গতকাল বুধবার দেবিদ্বারের মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোকতল হোসেন ওই স্কুলের ১০ম শেণীর এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় ওই প্রধান শিক্ষককে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন।
এদিকে পুলিশের উপর হামলা, পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাঁধাদানের অভিযোগে দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক মুক্তার আহমেদ মলি বাদী হয়ে এজহারভুক্ত ১০জন ও অজ্ঞাতনামা ২০০ জনসহ ২১০জনকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সরোজমিনে ঘটনাস্থল মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হাজী মো. বাহালুল হক, সহকারি শিক্ষক- শিক্ষিকাসহ পরিচালনা সদস্যরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীশূন্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। পাশ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল হাতেগণা। গতকালের ঘটনায় বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষের বেশকিছু দরজা-জানালা ভাংচুর অবস্থায় দেখা যায়।
মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হাজী মো.বাহালুল হক জানান, আজকে বিদ্যালয় খোলা থাকলেও গতকালের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা কেই বিদ্যালয়ে আসে নাই।
এ বিষয়ে একাধিক শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য জানান, এর আগে প্রধান শিক্ষক মো. মুক্তল হোসেন তিতাস উপজেলার দুলারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরিক্ষার্থী (ছাত্রীকে) যৌন হয়রানীর অভিযোগে ওই স্কুলে জুতার মালা পড়িয়ে বিদায় দেয়া হয়। সর্বশেষ দেবীদ্বার উপজেলা মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আবেদন করলে স্থানীয়রা এ লম্পট শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে। পরে রাজনৈতিক প্রভাবে এবং ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে তার বিরুদ্ধে নারী ক্যালেঙ্কারী এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ও স্কুল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার শর্তে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। স্কুল থেকে নিজ বাড়ি এক কিলোমিটার দূর হলেও তার পরিবারসহ ক্যাম্পাস সংলগ্নে বাসা ভাড়া করে দেয়া হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বুধবার (১৫ মার্চ) সকালে ৯টায় প্রধান শিক্ষক তার কক্ষে দশম শ্রেনীর এক ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয় এবং দ্বিতীয় দফায় সকাল ১০টায় প্রতিষ্ঠানের একটি শ্রেণী কক্ষে তিনি একই ঘটনা করে। ওই ঘটনার পর ছাত্রীর সহপাঠিরাসহ তাকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে তার বাবার কাছে ঘটনা বর্ণনা দেন।
এদিন দুপুরে বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে প্রধান শিক্ষক মো. মোকতল হোসেনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই ঘটনার জের ধরে শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবক ও এলাকাবাসীর যোগদানে বিকেল থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পুলিশ,ছাত্র-জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষে ৭ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হন।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের ব্যবহৃত মোটর সাইকেল ও তার মেয়ের জামাইর আরেকটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। ওই সময় পুলিশের রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলিতে ১৫ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীসহ ৫০জন আহত হন। এছাড়াও দেবীদ্বার থানার ওসিসহ ৭ পুলিশ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধান শিক্ষককে স্কুল মাঠে এনে বিচারের দাবী জানায়। এসময় পুলিশের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়ের দরজা-জানালা এবং প্রধান ফটকে ভাংচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা।
জানা যায়, প্রধান শিক্ষককে রক্ষায় তারপক্ষে বহিরাগত লোকজন এসে ছাত্রদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলায় অন্তত ৮-১০জন শিক্ষার্থী আহত হয়।
আহতদের মধ্যে নাঈম খন্দকার, মো. নাঈম ও জিহাদুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষকের ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে আমাদের উপর হামলা চালানো হয়েছে।
আহত শিক্ষার্থীদের দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। আহতরা সবাই ওই বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেনীর ছাত্র। ছাত্রদের উপর হামলার পর পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পরে তাঁকে প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ করে ছাত্র, অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
অবরুদ্ধ প্রধান শিক্ষক দেবিদ্বার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন।
সংবাদ পেয়ে বুধবার বিকেলে দেবীদ্বার সার্কেল এএসপি আমিরুল্লাহ ও দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ কমল কৃষ্ণ ধরের নেতুত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা চালায়। এসময় পুলিশও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং রাতে স্কুল ক্যাম্পাসের সমস্থ বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট ও সর্টগানের গুলি ছুড়লে এতে অন্তত ১৫জন গুলিবিদ্ধ হন।
গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত ৮জনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
রাত পৌনে ৯টায় কুমিল্লা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান ও দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডেজী চক্রবর্তী বিপুল সংখ্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে প্রধান শিক্ষকসহ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে আনার পথে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া করে।
এসময় ডিবি পুলিশসহ ৩ পুলিশকে আটক করে মারধর করে এবং এক পুলিশ সদস্যকে আটক করে রাখলে রাত সাড়ে ৯টায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ তাকে উদ্ধারে এলাকায় অভিযান চালায়। ওই সময় রাত ১০ পর্যন্ত এলাকাবাসীর সাথে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
এদিকে রাতে পুলিশের রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলিতে আরো অন্তত ১৫-২০ জন গুলিবিদ্ধ হয়।
গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতরা হলেন– সিয়াম (১৫), মিনহাজ (১৭), অলি (১৬), আকাশ (১৬) আরিফুল ইসলাম (২৬), সাব্বির (১৮) ও হৃদয় (১৭)। এদের প্রত্যেকেকে দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য বমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ০
পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ সদস্য জহিরুল ইসলাম ও সারোয়ারসহ ৫ পুলিশ আহত হয়েছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ কমল কৃষ্ণ ধর জানান, শ্লীলতাহানীর ঘটনায় ভিক্টিমের বাবা বাদী হয়ে মামলা করেছেন এবং পুলিশের দায়িত্বপালনে বাঁধা এবং পুলিশের অন্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। উভয় মামলায় আটক অভিযুক্তদের বৃহস্পতিবার বিকেলে কোর্ট হাজতে চালান করা হয়েছে।