দেশের রাজনীতি এবং ব্যবসা জগতের একটি পরিচিত, কিন্তু অন্ধকার দিক— মোস্তফা কামালের উত্থান। যিনি একসময় নিছক লবণ বিক্রেতা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তার জীবনযাত্রা, প্রভাব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পেতে আজ তিনি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং অতি বিতর্কিত এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তার নাম একদিকে সফল ব্যবসায়ীর পরিচয় পেলেও, অন্যদিকে তাকে এক বৃহৎ অর্থনৈতিক মাফিয়া হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, মেঘনা গ্রুপ, শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী তার ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেছে।
মোস্তফা কামাল: এক সফল ব্যবসায়ী, নাকি এক মাফিয়া?
মোস্তফা কামাল তার ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেছিলেন একটি সাধারণ কাজ থেকে – লবণ বিক্রি করে। কিন্তু তার নিছক শ্রম, কৌশল এবং যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে মেঘনা গ্রুপ গড়ে তোলেন। তবে এই চমৎকার উত্থানটি শুধু সাফল্য দিয়ে পূর্ণ ছিল না, এর পিছনে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন, যার মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। এমনকি দেশের রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থনীতির মধ্যে তার ভূমিকা আজ এতটাই শক্তিশালী যে, তাকে “মাফিয়া” হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
২০০৮-২০২৪: মাফিয়া মোস্তফার উত্থান
২০০৭ সালের আগে, মোস্তফা কামাল বাংলাদেশের শীর্ষ ১০০ ব্যবসায়ীর তালিকাতেও ছিলেন না। তার কাছে ছিল মাত্র ৫টি কারখানা, যার বেশিরভাগই ছিল দেউলিয়া। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে, পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। শেখ হাসিনার শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, মোস্তফা কামাল দ্রুত তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকেন। আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্ক, বিশেষ করে শেখ হাসিনার দলের দিকে তার আনুগত্য এবং সমর্থন তাকে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্থান করে দেয়। তার এই ব্যবসায়িক উত্থান একদিকে যেমন তার পরিশ্রমের ফল, অন্যদিকে তেমনি এই উত্থান হয়েছে রাজনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে।
একাত্তর টেলিভিশন: সরকারী প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার
মোস্তফা কামালের আরেকটি ভয়াবহ প্রভাব রয়েছে একাত্তর টেলিভিশনে। একাত্তর টেলিভিশন, যা বাংলাদেশের অন্যতম বিতর্কিত সংবাদ চ্যানেল হিসেবে পরিচিত, তা মূলত শেখ হাসিনার সরকারের প্রচারমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এই চ্যানেলটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর জন্য এবং জনগণের কাছে একপেশে তথ্য প্রচার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। মাফিয়া মোস্তফার অধীনে থাকা এই টেলিভিশন চ্যানেল, ২০২৪ সালের বিপ্লবের সময়ও, জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে কাজ করেছে।
শেখ পরিবারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক: ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য প্রসারিত
মোস্তফা কামাল তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করার জন্য শেখ পরিবারের সাথে তার সম্পর্কের পোক্ত ভিত্তি গড়েছেন। তিনি তার মেয়ে তানজিমা মোস্তফার বিয়ে শেখ হাসিনার বোনের ছেলে ওয়াসিকুর রহমানের সাথে দেন। এই পারিবারিক সম্পর্ক তার ব্যবসায়িক সুবিধাকে আরো দৃঢ় করে, যার মাধ্যমে তিনি শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। ২০১৩ সালে তিনি শেখ ফজলে নুর তাপসের সাথে মধুমতি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার ব্যবসায়িক প্রভাবকে আরও বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে।
ফ্যাসিবাদী হাসিনার করুণায় মোস্তফার সাম্রাজ্য
ফ্যাসিবাদী হাসিনার শাসনকালে মোস্তফা কামাল আরও অঢেল প্রভাব অর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ দাতা হিসেবে, তিনি সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মিউজিয়াম নির্মাণের জন্য ৪২ কোটি টাকা দান করেন, এবং সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন। তার অবৈধ তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়া, বিশেষত ব্যাংক লুটপাট ও অর্থ পাচারের মাধ্যমে, তাকে শীর্ষে নিয়ে আসে। তার কাছে এমন বহু প্রমাণ রয়েছে যা দেখায় যে তিনি কীভাবে ক্ষমতার শীর্ষে গিয়ে নিজের এবং সরকারের দুঃখজনক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছেন।
মেঘনা গ্রুপ: কর ফাঁকির আঁতুড়ঘর
মোস্তফা কামালের মেঘনা গ্রুপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কর ফাঁকির এক কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে তিনি তার কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) দাবি করেছে যে, তিনি এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মেঘনা গ্রুপের মাধ্যমে তিনি আন্ডার-ইনভয়েসিং আমদানি, জাল কভার নোট, ব্যাংক কমিশন এবং স্ট্যাম্প ডিউটি অপব্যবহার করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন। তার এই অপরাধগুলোর ফলে দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তিনি এখনও কার্যকরীভাবে এই শাসন ব্যবস্থার আওতায় আছেন।
অর্থনৈতিক অঞ্চল ও মাফিয়া সিন্ডিকেট: অর্থনৈতিক শোষণ
মোস্তফা কামাল হাসিনার শাসনকালে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলেন। এসব অঞ্চলে তিনি দরিদ্রদের জমি দখল করে এবং স্থানীয় জনগণের জীবিকা ধ্বংস করে নিজের ব্যবসার জন্য জায়গা তৈরি করেন। তার এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত বেশিরভাগ কোম্পানি ভারতীয় নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এবং এর অধিকাংশ কর্পোরেট কর্মকর্তা ভারতীয়। মোস্তফা কামাল একটি বিশাল সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছেন যা খাদ্য পণ্য, ভোজ্যতেল, চিনি, চাল ও অন্যান্য জরুরি দ্রব্যের বাজারে মূল্য সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। তার এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা দেশের বাজারকে চরমভাবে অস্থিতিশীল করেছে।
মোস্তফা কামালের বর্তমান অবস্থান: শক্তিশালী, কিন্তু শঙ্কিত
মোস্তফা কামাল এখন তার ব্যবসায়িক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তবে তার অতীতের অপকর্ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলি আজও জনগণের কাছে অজানা নয়। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে তার অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মুছে ফেলতে চেষ্টা করছেন। তার বিরুদ্ধে আরও তদন্ত চালানো এবং তার অপকর্মের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
জাতীয় বিচার দাবি
২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের বিপ্লব বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। তবে, এই বিজয় শেষ পর্যন্ত তবেই পূর্ণতা পাবে যদি দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী মোস্তফা কামালের মতো লোকদের বিচারের আওতায় আনা হয়। কারণ, এই মানুষটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করলে, আগামীতে তিনি আবারো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন।