বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমারের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। যিনি একসময় ছিলেন ‘ফ্লপ মাস্টার’—আর পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার ‘মহানায়ক’। অভিনয়, ব্যক্তিত্ব আর একাগ্রতার যে সম্মিলন, তা-ই তাকে উপহার দিয়েছিল এই অনন্য পরিচয়।
১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় জন্ম অরুণ কুমার চ্যাটার্জির। পরিবার ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত। বাবা মেট্রো সিনেমা হলে কাজ করতেন, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মঞ্চে অভিনয় করে জিতে নেন সোনার পদক।
স্কুলজীবন শেষে ভর্তি হন গোয়েঙ্কা কলেজে, কিন্তু পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। চাকরি নেন কলকাতা পোর্টে। তবে হৃদয়ের গভীরে বাসা বেঁধে ছিল রূপালি পর্দার স্বপ্ন। নানির দেওয়া ‘উত্তম’ নামটিই পরে হয়ে ওঠে তার স্থায়ী পরিচয়।
১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমা দিয়ে তার অভিনয়জীবনের শুরু। কিন্তু একে একে পাঁচ বছর ধরে সিনেমা মুক্তি পেলেও কোনোটি সফল হয়নি। তাকে নিয়ে চলচ্চিত্রপাড়ায় তখন অনেক কটাক্ষও হয়েছিল। অনেকে ডাকতেন—‘ফ্লপ মাস্টার’। তবে সেই ব্যর্থতা তাকে ভেঙে দেয়নি। বরং আরও দৃঢ় করেছিলেন নিজেকে।
১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বদলে দেয় তার পুরো পথচলা। এই সিনেমায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাজিমাত করেন উত্তম। এই জুটি হয়ে ওঠে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কালজয়ী রসায়ন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উত্তম কুমার হয়ে ওঠেন একের পর এক হিট সিনেমার নায়ক। তিনি শুধু রোমান্টিক চরিত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কমেডি, ট্র্যাজেডি, গোয়েন্দা এমনকি খলনায়কের চরিত্রেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’-য় ব্যোমকেশ বক্সী কিংবা ‘অমানুষ’-এ রাজা সাহেব চরিত্রে তার অভিনয় আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে।
১৯৭৫ সালে ভারত সরকার তাকে ‘মহানায়ক’ উপাধিতে ভূষিত করে। এই উপাধি শুধু তার তারকাখ্যাতির স্বীকৃতি নয়, বরং একটি সময়, একটি আবেগ ও একটি সংস্কৃতির প্রতীক।
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমার সেটে অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তম কুমার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কলকাতার একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। তার মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে ঠিক আগের মতোই জীবন্ত। উত্তম কুমার কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার এক আবেগের নাম। আজও নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা, একচিরস্থায়ী নায়কের প্রতিচ্ছবি।