শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫

বইমেলা: বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত থাকুক আগামী প্রজন্ম

-বিজ্ঞাপণ-spot_img

সাজ্জাদ শরিফ
বাঙালির প্রাণের মেলা হলো একুশে গ্রন্থমেলা। আমাদের আবেগি মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা অমর একুশে বইমেলা। আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তন্মধ্যে একুশে বইমেলা হলো সর্বোকৃষ্ট মেলা; যেখানে জ্ঞানের বিনিময় ঘটে বইয়ের মাধ্যমে। বইপড়া ব্যতীত জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ নেই। তাই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বই হলো মানুষের জাগতিক, মনোস্তাত্তিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে উপনীত হওয়ার প্রধান সোপান। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। শিক্ষার জন্য বই-ই আলোকিত জগতের দিশারী।

বইমেলা মানে বই-উৎসব। হাজার রকমের বই নিয়ে বসে থাকে পুস্তকবণিকেরা। নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মৌ মৌ করে চারপাশ। শেকড়ের অতীত, আশাজাগানিয়া বর্তমান আর স্বপ্নময় ভবিষ্যত মিলেমিশে একাকার হয়ে যেখানে ছড়ায় আশার আলো। আমাদের কাছে বইয়ের সংজ্ঞা এমনই। কিন্তু যে রচনা সত্য ও সুন্দরের নির্মাণের অঙ্গীকারে মুখরিত নয়, সেটাকে আমরা বই বলি কী করে?

অভিধান অনুযায়ী বই শব্দের উৎস হলো ওহি। ওহি থেকে বহি। বহি থেকে বই। বই শব্দটি ওহি থেকে আসার আরেকটি দলিল বাইবেল। বাইবেল গ্রিক শব্দ। এ শব্দের অর্থও বই। সুতরাং বই যদি জ্ঞানের উৎস হয়, ধারক-বাহক হয়; প্রচারক ও সংরক্ষক হয়; তাহলে সেই জ্ঞানের মৌলিক শিকড় যে ওহি; সেটা অস্বীকারের কোনো সুযোগ আছে কি? বরং আমর জোর গলায় বলতে পারি, আলোকিত মানব সভ্যতা ও বিকশি মানবতার মূলে দীপক আলোই হলো ওহির জ্ঞান। সভ্যতার ইতিহাসে সাদরিত বই-ই সেই সত্যতার প্রদীপ্ত দলিল।

ওহির বিভায় রচিত বই যেমন রয়েছে; তেমনি আছে ওহি-বর্জিত। কিন্তু আমাদের প্রাণের বইমেলায় ওহি-সিঞ্চিত বইয়ের কোনো ঠাঁই হয় না। বরং সেসব ওহি-বঞ্চিত শেকড়হীন বই ও ওহিকেন্দ্রিক বইয়ের তফাতটা সভ্যতার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কুরআনের শুরুতে আল্লাহ বলেন —
“আলি-লাম-মিম, এটা সেই গ্রন্থ, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিদের জন্য এটা পথনির্দেশ।” পৃথিবীর কোনো বইয়ের ক্ষেত্রেই এটা দাবি করার শক্তি কারো নেই যে, এতে কোনো কোনো সন্দেহ নেই। নিরঙ্কুশভাবে যা বলা যায় ওহি থেকে প্রাপ্ত গ্রন্থের বেলায়। আমাদের ধর্মে এ বইয়ের গুরুত্ব বোঝা যায় প্রিয় নবীজির হাদিসের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন—
“আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে থাকলে তোমরা কখনো পথহারা হবে না। তা হলো, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবির সুন্নত।

আল্লাহর গ্রন্থ জগতের সর্বাধিক পঠিত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং অনুপম রূপে সংরক্ষিত এ বইটিই মুসলিম উম্মাহর প্রধান আশ্রয়। আমরা আরও সহজ করে বলতে পারি যে, আল কুরআনের সূচনা থেকেই শুরু হয় ইসলামের অভিযাত্রা। এর পূর্ণতার মাধ্যমেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের গর্বের ধর্ম। এরপর মুসলিম উম্মাহ সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে দিয়েছে এই আলোকিত পয়গামের সুস্পষ্ট বার্তা। এ জ্ঞানের আলোদ্ভাসিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর। পবিত্র এই বইয়ের সাথে উম্মাহ ও তার সন্তানদের এমনভাবে বেঁধে দিয়েছে যে, বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদেরকে এই শিকড় থেকে আলাদা করতে পারেনি।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। দীর্ঘ সত্তর বছর রাশিয়ার বর্বরতার কাছে বন্দি ছিলো ১৯৯২ সালে মুক্ত হওয়া মুসলিম দেশগুলো। এ দীর্ঘ সময়ে নামাজ তো দূরের কথা, মুখে কালেমা পড়ারও অনুমতি ছিল না। মাদরাসাগুলো বিরান করা হয়েছে। মসজিদগুলো হয়েছিল ঘোড়ার আস্তাবল। এই পাষাণ পরিবেশে মুসলমানদের একদল হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় দল বার্ধক্যে উপনীত হয় আর পরের প্রজন্ম তখন ভরা যৌবনের রোদেলা দুপুর পার করছে। জুলুম ও অত্যাচারের পাশবিক সমাজতন্ত্রের পতন হলে দেখা গেল, মুসলমান যুবকদের অনেকেই হাফেজ-আলেম। বর্বর সমাজতন্ত্র তাদের জীবন তছনছ করে দিলেও ইসলামি শিক্ষা ও সভ্যতায় তাদের খুনি দাঁত বসাতে পারেনি। দীর্ঘ এ কালো সময়ে ” কুরআন ও দীনি শিক্ষা” বেঁচে থাকায় অনেকে অবাক হলেও উম্মাহর রাহবারদের সরল স্বীকারোক্তি ছিল— মাটির নিচে প্রতিষ্ঠিত দীনি মাদরাসার ফসল তারা।

সভ্য সমাজের সবাই বলেন, বই জ্ঞানের ভাণ্ডার। বই পড়ে মানুষ আলোকি হয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, আমাদের এ কালের কবি-সাহিত্যিকের আধুনিক রনচনাবলি কি সত্যি আলো ছড়ায়? জ্ঞান ও আলো বিতরণ করে? প্রশ্নটা ভাবায় আমাদের। মেলায় গিয়ে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করলেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিষয়ক রচনার কথা বলছি না; কিংবা আধুনিক মিথ্যাচারের প্রসার চালানো ইতিহাসও আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ ওগুলো সৃজনশীলতায় যায় না। থাকে তারুণ্যের বুক কাঁপানো উপন্যাস আর গল্প-কবিতা। মেলায় ঘুরে বেড়ানো কোনো আদর্শ মা-বাবা তার সন্তানের হাতে গল্প-উপন্যাসের ভালো কোনো বই তুলে দিতে পারবে? এক কবিকে তার কবিতার উন্মাদনা নিয়ে অভিযোগ করলে তিনি হেসে বলেছিলেন, “আমার কন্যা যদি তার বন্ধুকে আনার কবিতার বই উপহার দিতে না পারে তাহলে আমার কবিতার স্বার্থকতা কোথায়”?

এই যদি হয় দেশের প্রতম সারির একজন কবির কাব্যদর্শন তাহলে আমাদের ‘প্রাণের মেলায়’ কীসের মেলা বসে সেটা কি ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে? মূলত এই সময়ের পথহারা কবি-সাহিত্যিক এবং তাদের সহযাত্রীদের এমন মানসিক পতনের কারণেই বইমেলায় ঠাঁই পায় না সত্যিকারের বই। তাদের ভয়, ওহির বিভায় উদ্ভাসিত কোনো বই যদি মেলায় আদরিত হয়ে ওঠে তবে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। তাই সৃজনশীলতা ও আধুনিক মনস্কতার উদ্ভট সব কথার দোহাই দিয়ে ‘লটারি’র নামে প্রতারণার মাধ্যমে বইমেলাকে বার বার বঞ্চিত করা হয় ‘সত্যিকারের বই’ থেকে, বইয়ের আলো ও সুবাস থেকে।

তবুও আমরা আশাবাদী। সাধের এ ‘বইমেলা’ একদিন সত্যিকারের বইমেলা হয়ে উঠবে। তখন এ বইমেলা থেকেই জাতি পাবে ওহির আলোকে রচিত নানা রঙের পথচলার দীপক প্রদীপ। ব্যক্তির সংশোধন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রী সমৃদ্ধি আনয়নে রচিতত হবে সত্যিকারের জ্ঞানের বই। যে বই সকল ক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তার পরীক্ষিত অঙ্গীকারে রচিত হয়ে নববি আলো জ্বালাবে আমাদের ঘরে ঘরে। অসভ্যতা ও নোংরামো ছড়ানো বইয়ের বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত থাকবে আগামী প্রজন্ম। ওহির আলো থেকে বেরিয়ে আসা বই-ই পরিপূর্ণ স্বার্থকতায় ভরে তুলবে বইকেন্দ্রিক সব আয়োজন। সেদিন হয়তো বাংলা ভাষার সব রচনাই ‘বই’ হবে আর আমাদের প্রাণের বইমেলা হয়ে উঠবে ঐশী আলোয় উদ্ভাসিত বইমেলা। সেদিনই অর্থবহ হয়ে উঠবে বইমেলার সব আয়োজন।

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

ইরান গুলি চালাতে চাইলে বলেছি, এগিয়ে যাও: ট্রাম্প

কাতারে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর আগে ইরান সর্তক করেছিল বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০তম জন্মদিনের...

মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় নতুন তথ্য দিলো র‍্যাব

কুমিল্লার মুরাদনগরে ঘরের দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার মূল হোতা শাহ পরানকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। শুক্রবার (৪...

গাজার মানুষ নিরাপদে থাকুক, এটাই চাই : ট্রাম্প

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকা এখন এক মৃত্যুপুরী। প্রতিদিন ইসরায়েলি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গাজার মানুষ নিরাপদে থাকুক, তিনি...

সন্তানকে দেখার আগেই ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় প্রাণ গেল ফিলিস্তিনি ফুটবলারের

ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন গাজা উপত্যকার ফুটবলার মুহান্নাদ আল-লী। তিনি ছিলেন ম্যাগাজি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা এবং খাদামাত আল-ম্যাগাজি ক্লাবের তারকা খেলোয়াড়। বৃহস্পতিবার (৪...

সম্পর্কিত নিউজ

ইরান গুলি চালাতে চাইলে বলেছি, এগিয়ে যাও: ট্রাম্প

কাতারে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর আগে ইরান সর্তক করেছিল বলে দাবি করেছেন...

মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় নতুন তথ্য দিলো র‍্যাব

কুমিল্লার মুরাদনগরে ঘরের দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে...

গাজার মানুষ নিরাপদে থাকুক, এটাই চাই : ট্রাম্প

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকা এখন এক মৃত্যুপুরী। প্রতিদিন ইসরায়েলি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে...