জুলাই আন্দোলন চলাকালীন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পক্ষ নেওয়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষকদের অনেকেই এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় এসব আওয়ামী দোসর শিক্ষকদের অপসারণের দাবি জানালেও প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করছে না।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল অনলাইনে ফাঁস হওয়া ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের জুম মিটিংয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বিভাগের ১৩ জন শিক্ষক হাসিনার গদি রক্ষায় নানা ফন্দিফিকিরে বক্তব্য রাখেন এবং হাসিনা পতনের এক দফার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এমনকি এক দফার পক্ষে থাকা সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাইকে যেকোনোভাবে প্রতিহত করার হুমকিও দেন কেউ কেউ।
এছাড়াও এই শিক্ষকদের অধিকাংশই ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ও শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে নৌকা মার্কা প্রচারণায় অংশ নেন।
জানা যায়, ১০ মে ২০২৩ সালে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আব্দুল বাতেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ববি শিক্ষকদের একটি কমিটি করা হয়েছিল। গোপন সভায় অংশ নেওয়া এই শিক্ষকদের অধিকাংশই ঐ কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সেসময় ক্লাস কার্যক্রম বাদ দিয়ে অফিস সময়ে রাস্তায় ও বাজারে নেমে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছিলেন তারা। যা নিয়ে শিক্ষক না রাজনৈতিক কর্মী—এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুল বাতেন চৌধুরী গোপন সভায় শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিকে “ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান” করা সহ হাসিনার বিপক্ষে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে আন্দোলনের বিপক্ষে ঘৃণ্য দীর্ঘ বক্তব্য দেন। এমনকি কারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এবং কারা বিপক্ষের তা এখনই বোঝা যাবে বলে হুংকার দেওয়া এই শিক্ষক বর্তমানে ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও এখনো মূল্যায়ন কমিটির সদস্য এবং ক্লাস্টার-০২ এর আহ্বায়ক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।
গোপন সেই অনলাইন সভায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যেকোনোভাবে প্রতিহত করে শেখ হাসিনার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও আন্দোলন সমর্থনকারী শিক্ষকদের কঠোর হস্তে দমনের হুমকি দেওয়া তৎকালীন প্রক্টর ড. মো. আব্দুল কাইউম এখনও দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করছেন। বর্তমানে তিনি মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। এছাড়াও একাধিক অর্থবণ্টন ও অর্থ-সংশ্লিষ্ট কমিটিতে রয়েছেন বলেও জানা গেছে। ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির ১২ নং সদস্য ছিলেন তিনি। জুলাই আন্দোলনের সময় রাতে শিক্ষার্থীদের মেসে মেসে পুলিশ দিয়ে তল্লাশি চালানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি প্রক্টরের দায়িত্বে থাকাকালীন তার ও পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতেই ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই হামলা চালায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। এই বিষয়েও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং ছাত্রলীগের প্রতি তার সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখা যায়।
অন্যদিকে ড. আব্দুল কাইউমের স্ত্রী ড. ইসরাত জাহান একই সভায় শেখ হাসিনাই একমাত্র ভরসার স্থল এবং তার প্রতি আস্থা রাখতে চান বলে বক্তব্য দেন। বর্তমানে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং বিভাগটির ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। তিনি ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির ১০ নং সদস্য ছিলেন। জানা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর এই জুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন।
হাসিনার গদি বাঁচানোর অনলাইন ঐ সভায় শেখ হাসিনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির ০৫ নং সদস্য, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তারেক মাহমুদ আবির। সভায় তিনি কারা এক দফার পক্ষে আছেন তাদের দেখতে চান এবং হাসিনার জন্য কিছু করে দেখানোর এখনই সময় বলে বক্তব্য রাখেন। তিনি এখনো মূল্যায়ন কমিটির সদস্য পদে রয়েছেন এবং নানাভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রভাব খাটাতে তৎপর আছেন।
এছাড়াও গোপন সভায় বক্তব্য রাখা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির ০২ নং সদস্য মোহাম্মদ তানভীর কায়সার বর্তমানে বিভাগের চেয়ারম্যান এবং কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন হিসেবে বহাল রয়েছেন।
সেই সভায় গণহত্যাকারী হাসিনার জন্য দুঃখে গলা ধরে আসা এবং আবেগে কথা বলতে না পারার মতো কান্নাজড়িত পরিবেশ তৈরি করা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা দিল আফরোজ খানম সম্প্রতি বিভাগটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হুমকি প্রদানের অভিযোগকারী শিক্ষক জামাল উদ্দিনও মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়াও গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. হেনা রানী বিশ্বাস, ড. মো. শফিউল আলম, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মো. আরিফ হোসেন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষক ড. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, আইন বিভাগের শিক্ষক সুপ্রভাত হালদার এবং পদার্থ বিভাগের শিক্ষক ড. খোরশেদ আলম শিক্ষার্থীদের এক দফার বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
ভিডিও ফাঁস হওয়ার পরে এসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্দোলন গড়ে তোলে শিক্ষার্থীরা। তবে সাবেক ভিসি শুচিতা শরমিন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ পদে নানাভাবে পুনর্বাসন করেন। পরে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে ভিসি শুচিতাকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় সরকার।
এদিকে নিয়োগের আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন উপাচার্য অধ্যাপক তৌফিক আলম এখনো এই শিক্ষকদের বিষয়ে কোনো অবস্থান নেননি। ফলে তারা আগের মতোই প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক সিদ্ধান্তে। কেউ কেউ তৎপর রয়েছেন জুলাই চেতনাকে বিতর্কিত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বর্তমান উপাচার্যের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তবে তাদের দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। এ অবস্থায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি তুলেছেন দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ও আত্মস্বার্থে গণহত্যাকারীকে টিকিয়ে রাখতে এমন ঘৃণ্য সমর্থন দেওয়া নৈতিকতাবিবর্জিত এসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।
এ বিষয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ বলেন, ‘নতুন উপাচার্য স্যারের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছি যারা জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের যেন কোনো লাভজনক পদে না রাখা হয়। কিন্তু তিনি এখনও আমাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। তার এই নির্লিপ্ততা উদ্বেগজনক।’
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াহিদুর রহমান বলেন, “যারা এক দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নে ইন্ধন দিয়েছিলেন, তারা আজ পদোন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের স্পষ্ট দাবি, এসব ফ্যাসিবাদপন্থী শিক্ষকদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত যেন কোনো মূল্যায়ন বোর্ড না বসে।”
নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকা ও বিবৃতি দেওয়া শিক্ষকদের একজন, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল আলিম বছির বলেন, “বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। কারণ এই সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সরকার। ইস্যুটি জটিল হলেও প্রশাসন এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছি।”
জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সেই সভায় তোপের মুখে পড়া ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মুহাম্মদ মুহসিন উদ্দীন বলেন, “ডিন, চেয়ারম্যান এগুলো একাডেমিক পদ। যদি কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ থাকে কিংবা বিভাগীয় তদন্ত চলমান থাকে, সেক্ষেত্রে উপাচার্য চাইলে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ উপাচার্যের এখতিয়ার। তিনি চাইলেই পারেন।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (অন্তর্বর্তীকালীন) অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে আছে, পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্যতা যাচাইপূর্বক বিধি মোতাবেক যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবো।”