মো.মাসুম ইসলাম, রাজশাহী প্রতিনিধি: অভাবের তাড়নায় পরিবারকে সুখে রাখতে জন্মভূমি ও স্বজনদের ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেয়া প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অনেক নারী শ্রমিকও রয়েছেন। যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত। প্রবাসে থাকা নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের তথ্য প্রায়ই বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিবেদনে জানা যায়। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণ হতবাক করে দেয়ারই মত। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সূর্য্য খাতুনের সঙ্গে।
তিনি চকরাজাপুর ইউনিয়নের চর কালিদাস খালি গ্রামের মৃত শরিফুল ইসলামের স্ত্রী। তার বয়স প্রায় ৩৬ বছর, দুই কন্যা সন্তানের জননী তিনি। স্বামী মৃত্যুবরণ করেছে তিন বছর আগে। অভাবের সংসারে এক প্রকার দিশেহারা তিনি। এমন সময় পরিচিত রফিকুল ইসলামের প্রলোভনে পরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সূর্য্য খাতুন। কিন্তু সেখানে গিয়ে পরেন চরম বিপদে। অভাবের তাড়নায় প্রবাসে পাড়ি দেন তিন মাস আগে। তবে কে জানতো, সূর্য্য খাতুন একদিন অসহায়ের মতো আকুতি করে বেড়াবেন প্রাণে বাঁচা ও দেশে ফেরার জন্য।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সূর্য্য খাতুনের মা রেবেকা খাতুন আইনি প্রতিকার চেয়ে বাঘা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে এক সময় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নারী গৃহকর্মী পাঠানোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় দেশটির সরকার। অন্য দিকে বিদেশে নারী গৃহকর্মী দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বেশকিছু বিধিমালা থাকলেও কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি সরকারের দেয়া নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়াটে দালালদের মাধ্যমে নানা রকম মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার নারীকে বিদেশে পাঠায়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে সৌদি আরবে। কিন্তু এই সকল দালালেরা আর কোন খোঁজ নেন না সেই নারীদের।
সূর্য্য খাতুনের ভাষ্য অনুযায়ী, ভালো বাসাবাড়িতে কাজ, মাসে ১২০০ রিয়ালের(বাংলাদেশী প্রায় ৩৩ হাজার টাকা বেতন) মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী মধ্য উদয় নগর গ্রামের আজিমুদ্দিন শেখ এর ছেলে রফিকুল শেখ ও সহিদুল শেখ ( বর্তমানে রফিকুল শেখ ও সহিদুল শেখ তাদের পূর্বের স্থান থেকে এসে বাঘা উপজেলার বাজুবাঘা ইউনিয়ন এর তেপুকুরিয়া গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করছে) তাকে সৌদি আরবে পাঠায়। বাড়ির মালিক তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাবে, আরো অনেক লোভনীয় সব সুযোগের কথা। এরপর তিন মাস আগে সৌদি আরবে পৌঁছাই, এয়ারপোর্টে কেউ নিতে আসেনি। প্রায় ছয় ঘন্টা অপেক্ষার পর আমাকে একটি কোম্পানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কিছু দিন পর আরেক কোম্পানি কিন্তু গত তিন মাসেও আমাকে কাজ দেয়নি। দুপুরে ভাত- সবজি, রাতে ভাত নুডলস দিয়ে মেখে খেতে দেয়। দেশে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা বা রুম থেকে বের হতে দেয় না। প্রতিদিন রফিকুলদের ফোন দিই। কিন্তু সে ফোন ধরে না, প্রথম দিকে কথা বলত কিন্তু সমস্যার কথা বললে গালিগালাজ করে ফোন কেটে দিত। এখন আর ফোন ধরে না। কোন সমাধান বা কাজের ব্যবস্থা করে না।
তিনি জানান, রফিকুলরা ঢাকার এজেন্সি মনিশা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর অলি মোহাম্মদ খানের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছে। সেও আমার ফোন ধরেনা এবং কোন প্রকার যোগাযোগ করে না। এখানে আমার প্রায় বাংলাদেশি ৪০ জন নারী গৃহবন্ধী অবস্থায় আছি।
সৌদি আরবের গৃহবন্ধী অবস্থায় থাকা ৪০ জনের মধ্যে বেশ কয়েক জন নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রফিকুলদের মতো দেশের বিভিন্ন জেলার দালালদের মাধ্যমে বিদেশে ভালো কাজ, অনেক সুযোগ সুবিধার কথা বলে এই সকল মহিলা সংগ্রহ করে অলি মোহাম্মদ খান। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর পর আর কোন প্রকার খোঁজ খবর রাখে না তারা। তাদের কাজ নেই, খাবার ব্যবস্থা সরবরাহের ব্যবস্থা নেই, দেশে দেনা, বাচ্চা, পরিবার এর বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন কয়েকজন। প্রবাসী নারী সূর্য্যসহ তাদের শুধু একটাই আকুতি- তারা এ নরক থেকে মুক্তি চান, বাঁচতে চান। দেশে পরিবারের কাছে ফিরতে চাই।
তারা আরও বলেন, আপনাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এমপি, প্রশাসন সহ সকলের সু-দৃষ্টি কামনা করছি। তাদের সহানুভূতি যদি আমাদের মতো অসহায়দের উপর পরে তাহলে আমরা পরিবারের কাছে ফিরতে পারবো বা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবো। এবং রফিকুল, সহিদুর ও অলির মতো দালাল দের কঠিন তম শাস্তির দাবি জানান। এরা যেন অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আর কারো সাথে এমন করতে না পারে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত রফিকুল শেখ বলেন, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। কাজ না পেলেও তারা প্রতি মাসে বেতন ঠিকই পাবে। প্রথম মাসে এক হাজার রিয়াল বেতন পেয়েছে। গত মাসের টা কয়েক দিনের মধ্যেই পাবে।
এ অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মো. হারুনুর রশিদ জানান, এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টির তদন্ত চলমান। তদন্ত সাপেক্ষে আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।