বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন পর্যায়ে গুম হওয়া ৬২৩ জন গুম হয়েছে বলে নিজেদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে হংকং-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)। এই সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা ও প্রতিবেদন জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজএ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি) এর কাছে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।
মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে পেশ করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, সংঘটিত করা এবং ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মূল হোতাসহ সকলের শাস্তিও দাবি করা হয়।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ধরে নেওয়ার পর জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের তথ্য-উপাত্ত নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে এএইচআরসি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২-এ বর্ণিত সংজ্ঞায়ন অনুসরণ করেছে।
জাতিসংঘের কাছে জমা দেয়া এএইচআরসি’র বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থাটি ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সংঘটিত গুমের তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এসব নথি থেকে জানা গেছে, এই সময়কালে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬২৩ জনকে গুম করা হয়েছে।
গুম হওয়া এসব ব্যক্তির মধ্যে ১৫৩ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া, নিখোঁজ হওয়ার পর ৮৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে এবং ৩৮৩ জন ভুক্তভোগীকে কারাগারে বা বাড়িতে ফিরে আসার পরে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে ফিরে আসার পর এসব ব্যক্তি রহস্যজনক কারণে নীরবতা পালন করছেন। এছাড়া, নিখোঁজের শিকার ৩ জনের পরিবারের কাছ থেকে কোনও হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি, যদিও তারা এর আগে তাদের মামলার বিবরণ প্রকাশ করেছিল।
জাতিসংঘের জমা দেয়া এএইচআরসি’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে এমন সংস্থাগুলিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে, যারা গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অন্তত ১৯৫ জনকে অপহরণ ও গুম করার সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ ৮৮ জনকে অপহরণ করে গুম করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) কমপক্ষে ১৮৮ জনকে অপহরণ করেছে এবং র্যাব ও ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ১২ জনকে অপহরণ ও নিখোঁজ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ইউনিট একজন ভিকটিমকে নিখোঁজ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে এবং পুলিশ ও আনসার (গ্রাম প্রতিরক্ষা দল) যৌথভাবে ২ জনকে অপহরণ ও নিখোঁজ করেছে।
এএইচআরসি এর অভিযোগ, পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা যেমন ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) উপরে উল্লিখিত সময়কালে কমপক্ষে ১৩৭ জনকে অপহরণ ও নিখোঁজ করেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের প্রকৃত সংখ্যা নথিবদ্ধ পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা অনেকের। এএইচআরসি কেবলমাত্র সেই মামলাগুলি নথিভুক্ত করেছে যা পরিবারগুলি প্রকাশ্যে দাবি করেছে। অনেকেই ভয়ের কারণে দাবি উত্থাপন করেনি এবং সে কারণে নাম প্রকাশ পায়নি বলেও দাবি সংস্থাটির।
এএইচআরসি এর বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সদর দপ্তরে একটি গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সংস্থাটির কয়েক ডজন কর্মকর্তাকে অপহরণের পর গুম এবং নিখোঁজ করেছে। বাংলাদেশ রাইফেলস পরবর্তীতে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে নামকরণ করা হয়। এই বাহিনীর কর্তৃক জোরপূর্বক গুমের হিসাব নথিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
প্রতিবেদনে এএইচআরসি এও বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকার নিখোঁজ ও নিহতদের পরিবারকে ক্রমাগত ভয়ভীতি ও হুমকির মাধ্যমে ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা ইউনিট ও ক্ষমতাসীন দলের শাখা-কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মুখে পড়ে পরিবারগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলি অস্বীকার করতে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ভাষায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কথা বলে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সাল থেকে জোরপূর্বক গুম সম্পর্কিত দায়ের করা কোনও হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনের কোনো সুরাহা করেনি।
বিবৃতিতে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ র্যাবের ছয় জন বর্তমান ও প্রাক্তন কমান্ডারের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়া স্টেট ডিপার্টমেন্টের র্যাব-৪ এর দুই প্রাক্তন কমান্ডারের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মানবাধিকার গ্রুপগুলির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। নিহতদের পরিবারগুলিকে নজরদারি ও ভয় দেখানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে মানবাধিকার কর্মী এবং ভুক্তভোগীরা এসব বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার কারণে ক্রমাগত প্রতিশোধের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গুমের শিকার পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিশোধ বা কোনো ক্ষতি হলে তা দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবশ্যই সেই দায়িত্ব বহন করতে হবে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত জাতিসংঘের সার্বজনীন এখতিয়ারের অধীনে স্বাধীন অনুসন্ধানী ব্যবস্থা তৈরি করা। কারণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ মোকাবেলার জন্য সার্বজনীন এখতিয়ারের নীতিগুলি প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের দাবি, জাতিসংঘকে জাতিসংঘের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে। যাতে তারা এই মামলাগুলো তদন্ত করতে পারে এবং জোরপূর্বক গুমের অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে পারে। এছাড়া, এসবে জড়িত সংস্থা এবং এর সদস্যদেরকে অবশ্যই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে দেওয়া উচিত নয়।