গত মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন এক রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে ভারত সফরে এসেছিলেন। কিন্তু ক্রমশ পরিস্থিতি পরিক্রমায় বুঝতে পারলেন, তাকে সিলেট ও আসামে ব্যাপক বন্যার কথাও ভাবতে হচ্ছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব উপায়ে জানিয়ে দিলো, ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই প্রতিবেশী দেশটিতে সবকিছুই ভালোয় ভালোয় চলছে, এমন ভাবার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের ঝকমকে দৃশ্যের বাইরে আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের কঠিন আরেক বাস্তবতা। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় যার নমুনা দেখা গিয়েছে। ইসলামপন্থীদের দমিয়ে রাখা কিংবা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্বকে চতুরভাবে সামলানোর দক্ষতা — এই সব কিছুর বাস্তবতায় শেখ হাসিনার শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা যেমন দৃশ্যমান, তেমনি ক্রমেই সুতীব্র বিভাজন ও অর্থনৈতিক দুর্দশার বিষয়টিও সত্য। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা আমাকে যেমনটা বলেছিলেন, হাসিনা একটি “তাসের ঘর তৈরি করেছেন” আর একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা যাতে সায় জানিয়েছেন।
বাস্তবতার নিরিখে হাসিনার পায়ের নিচে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে উঠছে। এই নড়বড়ে হয়ে উঠার গতি যদিও অনেকটাই ধীর। তাই একে জরুরি সমস্যা নয় বলে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। কিন্তু অবিলম্বে মোকাবেলা করা না হলে, এটি নিশ্চিতভাবেই বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। ২০২৩ সালে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা; আর ২০২৪ সাল থেকে শুরু হবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি পরিশোধের সময়কাল। ফলে এই জোর করে চাপিয়ে দেয়া স্থিতিশীলতার বহিরাবরণের চাকচিক্য হারানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে পুরোপুরি ধসে না পড়লেও, হাসিনার এই কথিত তাসের ঘর নড়বড়ে ঝবার উঠার ঝুঁকি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বেড়েছে। যার ফলে নিজেদের পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী এই দেশে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ভারতের উচ্চাকাঙ্খার যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাও আছে হুমকির মুখে।
দেশের অভ্যন্তরের কথা বললে, হাসিনা সরকার ঐতিহ্যগতভাবেই দুই মেরুতে বিভাজিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের পারস্পরিক সংঘাতের মাঝে অবস্থান করছে। যার প্রথমটি হলো, তিনি ক্ষমতায় আছেন, কিন্তু তার কোনো নির্বাচনী বৈধতা নেই; আর থাকলেও তা অতি সামান্য। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কারসাজি (এই কারসাজির চর্চা কেবল জাতীয় নির্বাচন ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ নয়), প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) অবিরাম হেনস্থা করে যাওয়া, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা, উন্নত ডিজিটাল নজরদারির যন্ত্রসামগ্রী ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা এবং ইসলামি ডানপন্থী রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার পর, আবার ভারসাম্য বজায় রাখতে তাদের দিকেই জোর করে ঝুঁকে যাওয়া — এই সব মিলিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার অনেকগুলো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
হাসিনা নিজের বাবা শেখ মুজিবুর রহমান—একটি একদলীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন, আর তার বিপরীতে গিয়ে হাসিনা উল্টো বাজি ধরেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর। এক্ষেত্রে যুক্তি, ভালো অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রদর্শন আর উদারভাবে শক্তি ব্যবহার করলে হাসিনার নেতৃত্বাধীন একদলীয় রাষ্ট্রটি টেকসই হবে। কিন্তু এখানেই দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.৮%, আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৪%। এছাড়া ৪২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশই কমছে, যা দিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আর তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ বর্তমানে রাজকোষের দ্রুত বাড়তে থাকা ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কোনোভাবেই বাড়ছে না।
এই পুরো পরিস্থিতির সঙ্গে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি যোগ করুন। আর তখনই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কেন মোমেন তার ভারত সফরে বাংলাদেশের পাট রপ্তানির উপর থেকে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অস্বাভাবিক রকমের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের নিদারুণ আগ্রহ, যার কারণে ঋণ পরিশোধ করা আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হলো রাশিয়ার সাথে ২০১৫ সালে করা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি। এই চুক্তির কারণে ঢাকাকে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা গুনতে হবে। কুদানকুলামে একই মানের একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারতকে সাকূল্যে ৩ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
প্রশ্ন হলো ঢাকা কেনো এই ধরণের চুক্তি মেনে নেয়? কারণ বৈদেশিক এসব অর্থায়নে অবকাঠামোগত প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া দেয়া যায়, পাশাপাশি অব্যাহত রাখা যায় গেঁড়ে বসে থাকা দুর্নীতি; একই সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রাজনৈতিক মায়াজালও অটুট রাখা যায়। তবে স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, হ্যাঁ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রাকে প্রশংসনীয় বললে কম বলা হয়। কিন্তু যদি কেউ যদি প্রত্যাশা করে, চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নতি, যেটি বহিঃ ও অভ্যন্তরীণ ঘাত-অভিঘাতের কারণে ক্ষীণ হয়ে যেতে বাধ্য। তবে এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের মোড়কে আচ্ছাদিত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোকে জিইয়ে রাখা যাবে এমন প্রত্যাশা যদি থাকে, তবে সেটি হবে একটি অযৌক্তিক আবদার। শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন, দেশে ইসলামপন্থীরা ও বিএনপি, যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ না পেলেও জনগণের সহানুভূতি ধরে রেখেছে—সেই দুই পক্ষের কেউই যেন তার ক্ষমতার দিকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলতে না পারে।
কিন্তু হাসিনার আসল চ্যালেঞ্জ তার জানাশোনা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আসছে না। তার চ্যালেঞ্জ আসছে নিরাপত্তা কাঠামোর আধিপত্যাধীন রাষ্ট্রকাঠামো ও নিজ দলের কাছ থেকে। যারা এত এত অবৈধ মুনাফা ঘরে তুলেছে যে, ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। এর ফলে হাসিনা এক কঠিন দোটানায় পড়েছেন। হয়, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন; নতুবা তিনি ফের নির্বাচনে কারসাজি করে আন্তর্জাতিক নিন্দা কুড়াবেন, যার পরিণতিতে দেখা দিতে পারে গণআন্দোলন ও সহিংসতা। হাসিনার উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, সেই বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায়, উভয় পরিস্থিতিই সুযোগসন্ধানী কোনো প্রতিপক্ষকে ক্ষমতার পালাবদলে প্রলুব্ধ করতে পারে — বাংলাদেশের ইতিহাসে যার নজির দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুরি ভুরি।
হাসিনার অভ্যন্তরীণ এই সমস্যার সঙ্গে তার বহিঃ নির্ভরশীলতার যোগসূত্র রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হাসিনা নয়াদিল্লীর উপর নির্ভরশীল হওয়ায়, ভারত যে ক্রমেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ থেকে মানুষের অভিবাসন বা রোহিঙ্গা সংকটকে ঘরোয়া রাজনৈতিক সুবিধায় পরিণত করার যেই অপকৌশল হিন্দুত্ববাদীরা গ্রহণ করেছে, তা মোকাবিলা করাও হাসিনার জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। তেমনি, চীনা অর্থ গ্রহণ করা রাজনৈতিক সমর্থনে রূপান্তরিত নাও হতে পারে। আবার, বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতেও ঢাকা হিমশিম খাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে নেয়ার যেই সিদ্ধান্ত ঢাকা নিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলবে।
এর সঙ্গে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরালো হওয়ার প্রেক্ষাপটও যুক্ত করতে হবে। এদের অনেককে গোপনে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যেই মনোভাব কঠোর হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি আরও টালমাটাল হয়ে উঠেছে। সহিংস হয়ে উঠতে পারে এমন কোন সংকট ঠেকাতে হলে হাসিনার দরকার মূলসড়কে উঠতে পারার কোনো পথ খুঁজে বের করা। এই উপমহাদেশের এখন যার একদমই দরকার নেই, সেটি হলো বাংলাদেশে অস্থিরতা।
লেখক পরিচিতিঃ অভিনাষ পালিওয়াল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তিনি “মাই এনিমি’জ এনিমি: ইন্ডিয়া ইন আফগানিস্তান ফ্রম দ্য সোভিয়েত ইনভেশন টু দ্য ইউএস উইথড্রয়্যাল” শীর্ষক বইয়ের লেখক। তার এই নিবন্ধ প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায়। যার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ফেস দ্যা পিপলের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।