মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তারা দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাঠিয়েছেন। এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন দেশে ব্যবসা খুলেছেন। কিনেছেন জাহাজ, বাড়ি, ফ্ল্যাট, হোটেল, ভিলা ও কমার্শিয়াল ভবন।
তবে এসব বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে কিছুই জানানো হয়নি। বিদেশে অর্থ পাঠাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু তারা সেই নিয়ম মানেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের সিআইডি যৌথভাবে এই বিষয়টি তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে মোস্তফা কামাল ও তার পরিবারের নামে-বেনামে একাধিক অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, মেঘনা গ্রুপ ২০১৮ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে একাধিক ব্যবসা চালাচ্ছে। সেখানেই রয়েছে তাদের দুটি বড় বাণিজ্যিক জাহাজ—‘মেঘনা ট্রেডার’ ও ‘মেঘনা প্রাইড’। জাহাজ দুটি প্রতিবছর গড়ে ২৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এই আয়ও দেশে ফেরত আনা হয়নি। মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী এবং তিন কন্যা এই জাহাজের মালিক। তাদের সিঙ্গাপুরের জাতীয় পরিচয়পত্রও রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তকারীদের দাবি, পাচারের অন্তত ৮০ শতাংশ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সরানো হয়েছে। তারা ভুয়া তথ্য ও কাগজপত্র দেখিয়ে টাকা বিদেশে নিয়েছেন। এরপর সেই টাকা দিয়ে বিদেশে কোম্পানি খুলেছেন। সেই কোম্পানির আয়কে বৈধ দেখিয়ে আরও বড় বিনিয়োগ করেছেন।
যেসব দেশে তারা বেশি বিনিয়োগ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে: সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, দুবাই, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও হংকং। এসব দেশে তারা হোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকান কিনেছেন।
এছাড়াও রয়েছে জাহাজ ও অন্যান্য ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বিষয়—এই সব বিনিয়োগে অর্থের উৎস যাচাই করা হয়নি। তারা যেসব দেশে বিনিয়োগ করেছেন, সেসব দেশে অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না।
দেশে তারা শুল্ক ফাঁকি ও ইনভয়েসে কারচুপির মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করেছেন। ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মোস্তফা কামালের গ্রুপ ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেন। কিন্তু এলসি অনুযায়ী ইনভয়েস দেখানো হয় মাত্র ৪৮ হাজার কোটি টাকার। ফলে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা গোপনে পাচার করা হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো—বিমা ও ব্যাংক কমিশনের অর্থ আত্মসাৎ। তাদের মালিকানাধীন নৌযান প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি। আর মোটরযান আছে প্রায় ১ হাজার ২০০টি। সবগুলোর জন্যই বিমা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিমা বাবদ প্রিমিয়াম নেওয়ার পর ৩০০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক কমিশনের ৬৩৮ কোটি টাকা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ২৫ কোটি টাকাও পরিশোধ করা হয়নি। ভ্যাট ফাঁকিরও অভিযোগ রয়েছে। প্রায় ৯৫ কোটি টাকার ভ্যাট তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেননি। মোটমাট, স্ট্যাম্প, ভ্যাট ও বিমা পলিসির টাকা মিলে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তারা।
২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী বিউটি আক্তার এবং তাদের সন্তানদের ৩১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ৩০ দিনের জন্য জব্দ করা হয়।
একজন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১৮ সাল থেকে বিদেশে বিনিয়োগে অনুমোদন দেওয়া কঠিন করে দেওয়া হয়। কিন্তু মেঘনা গ্রুপ এই অনুমোদন নেয়নি। তবে তারা একাধিক দেশে বিনিয়োগ করেছে।
দুদকের একাধিক অনুসন্ধানী দল এখন মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। তারা আরও অভিযোগ পেয়েছে, মোস্তফা কামাল শিশুখাদ্য বেশি দামে আমদানি করে তা কম ইনভয়েসে দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। শুল্ক ফাঁকি দেওয়া অর্থও পাচার করেছেন।
তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। নদী ভরাট করে নদীর গতিপথ নষ্ট করেছেন।
এছাড়া তারা ৯টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই ঋণের বড় অংশ ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকার বদলের পর মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ছে। সরকার এখন পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। অবৈধ সম্পদ, বিদেশে বিনিয়োগ এবং শুল্ক ফাঁকির ঘটনায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এই টাকায় দেশের বহু বাজেট বাস্তবায়ন করা যেত। তাই এসব অপরাধীদের শাস্তি জরুরি।’