‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত’ দ্রোহের কবি নজরুল কখন শান্ত হবেন, কেন শান্ত হবেন- বিদ্রোহীরা কী কখনও শান্ত হতে পারেন। তবুও তিনি শান্ত হবেন-‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না’ , নিপীড়িত জনতার কথা কবিতায়-গানে আমৃত্যু-আজীবন বলে গেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহে যিনি বেঁচে আছেন বাঙালির প্রতিটি বিপ্লবের সুরে।
শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিপ্লব থেকে পেছপা হননি দারিদ্রকে জীবনভর সঙ্গী করা এই মানুষটি।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের শতবর্ষ পার হয়েছে। তবুও এই পুরনো হয়নি, নজরুলের শুরু করা বিদ্রোহ। যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক থাকছে বিদ্রোহী সত্তা। বেঁচে থাকবে কবিতা। কবির বিদ্রোহী চেতনা- ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ কখনও নত হয় না কোনো অত্যাচারী শাসকের পদতলে। প্রেরণা দিয়েছেন নজরুল।
যখন শাসক অত্যাচারী হয়ে উঠবে শেকল পড়াবে হাতে তখনও নজরুলের কবিতা জানান দিবে, ‘এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল। এই শিকল পরেই, শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ জেগে উঠবে বিপ্লবী জনতা। ভাঙবে শিকল।
শুধু কী বিদ্রোহী ছিলেন দ্রোহের এই কবি, নাকি দ্রোহ এবং প্রেমিক সত্তা সমান্তরালে ধারণ করেছেন, যেইসব উঠে তার সাহিত্যের পরতে পরতে। যেখানে কবি বলে উঠেন- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’ কিংবা প্রেমিকাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত কবি বলে উঠেন- ‘ওগো ও চক্রবাকী; তোমারে খুজিয়া অন্ধ হ’ল যে চক্রবাকের আখিঁ!’ তখন নজরুল শুধু বিদ্রোহী নন, হয়ে যান পুরোদস্তুর এক প্রেমিক কবি।
কবিতায় শুধু বিদ্রোহ করে ব্যক্তিজীবনে চুপচাপ বসে থাকেননি নজরুল। যাপিত জীবনেও করে গেছেন বিদ্রোহ। শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলে কারাভোগ করেছেন। অনশনে বসেছিলেন একটানা ৩৮ দিন। ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন তিনি। ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য তার লড়াই প্রেরণা যুগিয়েছে স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের।
এক বিপ্লবী কবি কবিতার কাছে, প্রেমের কাছে ফিরেছেন বারংবার। বিরহে হয়েছিলেন এই বিপ্লবী কবিও কাতর। তাই বলেছেন- মোর অপরাধ শুধু মনে থাক! আমি হাসি, তার আগুনে আমারই অন্তর হোক পুড়ে খাক!’
সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন নজরুল। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ যেমন তার চোখে ছিল না, তেমনি জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদও তিনি মুছে ফেলতে চেয়েছেন। তাই তিনি বলতে গেছেন অনবদ্য ভাষায়, ‘সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!’ এমন করে আর কজন বলতে পেরেছেন।
হিন্দু কিংবা মুসলিম নজরুলকে একান্তই নিজের বলে কেড়ে নিতে পারেনি কেউই- কারণ অসাম্প্রদায়িক চেতনা তার কবিতায় ও জীবনে তিনি প্রমাণ করে গেছেন। তার কবিতায় তিনি বলেছেন- ‘গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।’ তার সন্তানের নামে রেখেছেন সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত- কৃষ্ণ মুহাম্মদ।
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, অসাম্প্রদায়িকতা, দ্রোহ, প্রেম এবং সাম্যবাদের কবি নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। দেশব্যাপী মানুষ কতশত আয়োজনে পালন করছে ‘নজরুলজয়ন্তী’। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, পরম মমতায় স্মরণ করছেন এই কবিকে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা(বাসস)জানিয়েছে, জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ২৫, ২৬ ও ২৭ মে কুমিল্লায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আজ বেলা তিনটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং কবির পৌত্রী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান খিলখিল কাজী।
অনুষ্ঠানে ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৩ ও ২০২৪’-এর জন্য মনোনীত গুণীজনদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।
আগামীকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের আয়োজনে জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে ‘চেতনা ও জাগরণে নজরুল’ শীর্ষক অনুষ্ঠান।
যুগে যুগে কবি নজরুল থাকবেন প্রাসঙ্গিক। বিদ্রোহের কবিতায় জাতি স্মরণ করবে জাতীয় কবিকে।