বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ২০২৪ সালকে আলাদা করেই স্মরণ রাখবে। এই চব্বিশেই গত ১৬ বছর ধরে চলতে থাকা স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছেন ‘কত বিপ্লবী’, আহত হয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন বছরে এই সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের যেমন প্রত্যাশার রয়েছে সেইসব কথা ফেস দ্যা পিপল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো–
দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কাজ করছেন সিয়াম চৌধুরী। নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্ব সম্পর্কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘স্থিতিশীলতা ধরে রাখা নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারকে কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তবে তটস্থ থাকতে হবে, এই কঠোরতা যেন ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনা করার মতো অবস্থায় না দাঁড়ায়, আবার বিপরীতে কোমল আচরণ যেন অশুভ শক্তির প্রাণশক্তি হয়ে না ওঠে। নাগরিক সচেতনতা অব্যাহত রাখা ভীষণ জরুরী। সেই সাথে দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারকদের প্রতিটি পা ফেলতে হবে বুঝে-শুনে, বিচক্ষণতার সাথে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, সংস্কারও তত কঠিন হয়ে উঠছে।’
সিয়াম চৌধুরী
সিনিয়র সাব-এডিটর, বিডিক্রিকটাইম
‘জুলাই বিপ্লবের মূল লক্ষ্যই ছিল বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। একটি দেশ তখনই বৈষম্যমুক্ত হয় যখন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ভারসাম্য লাভ করে। আমরা চাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করুক। আর এই অর্জনের মূল শর্তই হলো একটি সঠিক ব্যাংকিং অবকাঠামো। বিগত সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামী ঋন দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। ২০২৪ এ আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, তার প্রথম সফলতা হওয়া উচিৎ পাচার হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। খেলাফি হয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকা সরকার কঠোরভাবে আদায় করা। নিয়ম না মেনে যে লোন দেয়া হয়েছে, যে সব ব্যাংক ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ পরিচালনা পর্ষদ যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রতি বছর কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয় তা যেন বন্ধ করা হয়। কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান এলসির নামে টাকা পাচার করতে না পারে সে দিকেও নজর দিতে হবে। মূল কথা হলো দেশের ব্যাংকসমূহকে এমনভাবে সাজানো উচিৎ যেন নতুন কোন সরকার এলেও তারা যেন কোনো অন্যায় ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে না দেয়।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ব্যাংক কর্মকর্তা, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক
২০২৫ সালে বাংলাদেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমি ন্যায়, সমতা এবং ইনসাফভিত্তিক একটি শাসনের স্বপ্ন দেখি। দীর্ঘদিনের নিষ্ঠুর শাসনের পর, আমার আশা হলো এমন একটি সমাজ যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। আমি এমন একটি বাংলাদেশের কল্পনা করি যেখানে তরুণ প্রজন্ম নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারবে, দুর্নীতি দূর হবে এবং মেধাভিত্তিক আমাদের ভবিষ্যৎ গড়বে। এই বছর, আমি আশা করি নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য, শিক্ষা ও উদ্ভাবনের উন্নতি ঘটবে৷ এবং এমন সরকারকে পাবো যে জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। উজ্জ্বল আগামীর পথচলা শুরু হোক এখন থেকেই।
মোহাম্মদ নাইমুল ইসলাম, প্রভাষক, ফেনী ভিক্টোরিয়া কলেজ
বিপ্লবের পর নতুন বছর: আমার প্রত্যাশা
জুলাইয়ের অভ্যুত্থান আমাদের দেশকে স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত করেছে। এখন সময় একটি উন্নত ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার। আমার প্রথম প্রত্যাশা, একটি উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শিক্ষা হতে হবে সবার জন্য সমান সুযোগসম্পন্ন, যা নাগরিকদের দক্ষ, সৎ এবং দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলবে। পাশাপাশি, বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে রাষ্ট্রীয় সেবা যেন সহজে এবং স্বজনপ্রীতি ছাড়া সবাই পায়, সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে স্বৈরশাসনের আর কোনো সুযোগ না থাকার নিশ্চয়তা দিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমি এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে একটি সুশাসিত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি।
ইমরান হোসাইন রনি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নতুন সরকারের কাছে আমাদের তিন ধরণের প্রত্যাশা
১. সাধারণ মানুষ হিসাবে: আমাদের জনসাধারণের সবচেয়ে বড় সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে একটি হলো, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। আজকের দিনে মানুষের উপার্জনের অংকটা হয়তো পূর্বের তুলনায় বড় কিন্তু অর্থমূল্যের বিচারে এটা একটা প্রহসন যার বাস্তব প্রমাণ মেলে অর্থ-পণ্য বিনিময় করার সময়। সাধারণ মানুষের চাওয়াগুলোও সাধারণ। এইসব সাধারণ মানুষেরা তাদের সাধারণ প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে যেন কোন সেচ্ছাচারী বাজার ব্যবস্থা যেমন ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সিন্ডিকেট ইত্যাদির মত ‘অসাধারণ’ হিসাব নিকাষের সম্মুখীন না হয় সেই বিষয়ে সরকারকে খুবই সতর্ক এবং শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। আরও সোজা কথায় যদি বলি, বিগত সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বা ক্ষোভের যে প্রধান জায়গাটা ছিল সেটা হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। আমাদের একজন কৃষক, শ্রমিক বা স্বল্প আয়ের চাকুরিজীবী বাবা বা ভাই বাজারে গিয়ে দ্রব্যমূল্য মোকাবিলা না করতে পেরে যখন ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরেছেন তখনই সবচেয়ে বেশি গ্লানির মধ্যে তাঁরা পড়েছেন যে গ্লানি দীর্ঘদিনের রূপান্তরের ফল আমরা দেখেছি ‘২৪ এর জুলাইয়ে।
তাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পণ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের একদম নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। এটার বাস্তবায়নের জন্য প্অবশ্যই দেশে উৎপাদিত দ্রব্য সরাসরি কৃষক থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া প্রকৃত অর্থে টেকসই উন্নয়ন চাইলে সরকার কে অবশ্যই আমাদের পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর পুঁজিবাদের লাগামটা মোটাদাগে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি যেন গরিব আরও বেশি গরিব না হয়ে যায়।
২. একজন চাকরি প্রত্যাশি হিসাবে: আমাদের দেশের সমাজ এবং মানুষের জীবন ব্যবস্থা অনুযায়ী একটা ভাল চাকরি হলো আমাদের অর্জিত শিক্ষার অক্সিজেন যার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে একটা পরিবার তাই আমরা চাইবো, চাকরি নিয়োগ কাঠামোটা প্রশ্নাতীত ও জলের মত স্বচ্ছ রাখবে। চাকরি প্রত্যাশি প্রায় সবাই আমরা বেকার এবং পরিবারের উপর নির্ভরশীল তাই চাকরিতে আবেদন ফি এর নামে বেকার-শোষণ ব্যবস্থা থেকে সরকার যেন আমাদের পরিত্রাণে কাজ করে।
৩. নাগরিক হিসাবে: রাষ্ট্রের সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যেন কোন গ্রাহক অবৈধ হয়রানির স্বীকার না হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যেন কোন রাজনৈতিক পক্ষের তোষামোদি করতে না পারে সেটা সরকার নিশ্চিত করুক।
শোভন খান, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়