বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি রপ্তানি শিল্পে। কারণ, বিশ্ববাজারে দেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে, চিংড়ির মূল্যে ৪০ শতাংশেরও বেশি পতন দেখা গেছে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে ভেনামি জাতের চিংড়ি।
তুলনামূলক কম দামের কারণে বিদেশের বাজার অনেকটাই দখল করেছে ভেনামি জাতের চিংড়ি। সেজন্য দেশের বাজারে অস্বাভাবিক হারে চিংড়ির দরপতন ঘটেছে।
গত বছরের তুলনায় এ বছর বাগেরহাটের হাট-বাজারে কেজিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ির দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কমেছে। ঠিক এ কারণেই এই মাছ চাষের সঙ্গে জড়িতরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। সেজন্য হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারকরা বিশ্ববাজার ধরে রাখতে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের কথা বলছেন।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে চিংড়ি চাষে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে চিংড়ি মারা যাচ্ছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাষের তাড়াও রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পরামর্শ দিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে চিংড়ির চাষ বেশি হয়। এর মধ্যে বাগেরহাটে বেশি পরিমাণ ঘেরে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ করা হয়। কখনো জলোচ্ছ্বাসে ঘের ডুবে চিংড়ি ভেসে যাচ্ছে। আবার কখনো বা অনাবৃষ্টি আর ভাইরাসের কারণে ঘেরে চিংড়ি মারা যাচ্ছে। নানা কারণে একের পর এক বিপর্যয় লেগেই আছে চিংড়ি শিল্পে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ি রপ্তানিতেও পড়েছে প্রভাব।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর পাইকারি মৎস্য আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, কেজিতে ১২টি চিংড়ি ধরে এমন আকারের বাগদা কেজি প্রতি এক হাজার ১০০ টাকা, ১৫টির ক্ষেত্রে ৯০০ টাকা ও ২০টির ক্ষেত্রে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রে ৮টি ধরে এমন আকারের কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়।
উৎপাদন খরচের তুলনায় কম মূল্যে বিক্রি করার কারণে লোকসানের মুখে অনেক চাষি বিকল্প পেশা খুঁজছেন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস হুমায়ুন কবির জানান, ‘ভেনামি জাতের চিংড়ি বিশ্ববাজার দখল করেছে। স্বল্প জায়গায় কম খরচে এই চিংড়ির চাষ সম্ভব। দাম কমের কারণে বিদেশের বাজারে এর চাহিদাও অনেক বেশি। গত বছরের তুলনায় এ বছর বিদেশের বাজারে গলদা ও বাগদার চাহিদা কমেছে শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশ। আর দাম কমেছে শতকরা ৪০ শতাংশ। গত বছর যে আকারের এক পাউন্ড বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয়েছে ১০ ডলারে, এখন তা কমে বিক্রি হচ্ছে ছয় ডলারে। বিদেশের বাজারে দেশের বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা না থাকায় এই অঞ্চলের ৬১টি হিমায়িত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৪টি প্রতিষ্ঠান চিংড়ি ক্রয় করছে।’
তিনি আরও বলেন, বিদেশে চিংড়ি বাজার ধরে রাখতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতে হবে। দেশ এখনও গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশ্ববাজারে গলদা ও বাগদা চিংড়ির মূল্য বৃদ্ধির কারণে এই চিংড়ির চাহিদা কমে গেছে। ক্রেতারা এখন কম মূল্যের ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে গলদা ও বাগদা চিংড়ি মার খাচ্ছে। ২০২১ সালে আট মাস ধরে চার হাজার কন্টেইনার হিমায়ত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। আর ২০২২ সালে ওই আট মাসে মাত্র এক হাজার কন্টেইনার হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়েছে। বিদেশের বাজারে চিংড়ি রপ্তানি কমতে কমতে এখন মাত্র শতকরা ২০ ভাগে এসে নেমেছে। চিংড়ি রাপ্তানিকরা লোকসানের মুখে রয়েছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট এস হুমায়ুন কবিরের তথ্য মতে, ‘দেশে এখন বাণিজ্যিক ভাবে ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষ হচ্ছে না। তিন এলাকায় জাতটির চাষের পাইলটিং করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশের বাজার ধরে রাখতে দেশে দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দিতে হবে সরকারকে।’
বাগেরহাটের বারাকপুর এলাকার চিংড়ি চাষি আশ্বাদ আলী জানান যে প্রায় ২৫ বছর ধরে সে ৪০ বিঘা জমিতে মাছের চাষ করে আসছে। এক বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করতে সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। এখন আর সে চিংড়ি চাষ করতে চায় না।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন জানান, নানা কারণে সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। রপ্তানিকারকরা আগের মতো চিংড়ি ক্রয় করছে না। গলদা-বগাদা চিংড়ি গত বছরের চেয়ে কেজি প্রতি প্রায় ৫০০টাকা কমে গেছে। চিংড়ি চাষ অব্যাহত রাখতে হলে চাষিদেরকে কমপক্ষে শতকরা পাঁচ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। এছাড়া চাষিদেরকে আর্থিক সহায়তা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। তা না হলে সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্প শেষ হয়ে যাবে।
বাগেরহাটের বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ জাকির হোসেন জানান, গত বছর এই সময়ে প্রতিদিন তাদের আড়তে প্রায় দেড় কোটি টাকার গলদা ও বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয়েছে। এছর সেই পরিমাণ চিংড়ি মাত্র ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাইরের দেশে সেই ভাবে চিংড়ি না যাওয়ার কারণে দাম কমে গেছে। স্থানীয় বাজারে চিংড়ি বিক্রির কারণে দরপতন ঘটেছে। বিশ্ববাজারে যাতে চিংড়ি বিক্রি হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণে দাবি জানান।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল জানান, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে চিংড়ির উৎপদান ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ি রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চিংড়ি ঠিকমতো রপ্তানি না হওয়ার কারণে দেশের বাজারে চিংড়ির দাম কমে গেছে। এঅবস্থায় দেশে ও বিদেশে চিংড়ির বাজার সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, বাগেরহাট জেলায় ৭২ হাজার ৭২৪ হেক্টর জমিতে ৭৭ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। এর মধ্যে ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ৫২ হাজার বাগদা এবং ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। জেলায় ৫৫ হাজার চাষি চিংড়ি চাষের সাথে যুক্ত। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাগেরহাট জেলায় মোট ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। ওই অর্থবছরে খুলনা বিভাগ থেকে ২৪ হাজার ১০৪ মেট্রিট টন চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, এসব চিংড়ি রপ্তানি করে চার হাজার কোটি টাকা আয় করেছে দেশ। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাগেরহাট জেলায় মোট ৩৫ হাজার ৬৭২ মেট্রিট টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৩৬৭ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে দেশ তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা আয় করে।