আগুনে ঝলসে যাওয়া এক শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। এই দৃশ্য বিমান বিধ্বস্তের পর থেকেি সোশ্যাল মিডিয়ায়জুড়ে ভাঈড়াকল হতে থাকে, এমন মর্মান্তিক দৃশ্য কাঁদিয়েছে দেশের মানুষকে। সেই শিশু ‘আব্দুল্লাহ ছামীম’ আর বেঁচে নেই। স্বামী হারানোর বছর না ঘুরতেই সন্তানের এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন মা জুলেখা বেগম।
আব্দুল্লাহকে হারিয়ে গোটা পরিবার একটু একটু করে যখন স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ঘটা এমন দুঃসংবাদ শোকে বিহ্বল করে দেয় পুরো পরিবারকে।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত আব্দুল্লাহ ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। আজ তাকে বাবার পাশেই দাফন করা হয়েছে। জুলেখা বেগমের বুকজুড়ে এখন শুধু আহাজারি আর না বলা হাজারো প্রশ্ন।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএমখালি মাঝিকান্দি এলাকার আবুল কালাম মাঝি ও জুলেখা বেগম দম্পতির ছেলে আব্দুল্লাহ ছামীম (১৪)। থাকতেন ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ি, খালপাড় এলাকায়। ভাই বোনদের মধ্যে সবার ছোট ছামীম। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী ছিল সে। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। আগে মাদরাসায় পড়াশোনা করলেও পরবর্তীতে তাকে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। গত ডিসেম্বর মাসে প্রবাসে মারা যান বাবা আবুল কালাম মাঝি। এরপর থেকে মা, বোন ও বড় ভাইয়ের সাথে যত্নে বেড়ে উঠছিল ছামীম।
প্রতিদিনের মতো সহপাঠীদের সঙ্গে সোমবার (২১ জুলাই) বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছিলেন ছামীম। টিফিনের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি, এরইমধ্যে বিকট শব্দে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। সেই ঘটনায় অন্যান্যদের সঙ্গে গুরুতর আহত হয় ছামীম।
পরবর্তীতে তাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করে স্বজনদের খবর দিলে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দ্রুত ভর্তি করা হয় বার্ন ইউনিটে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে ছামীম।
এদিকে ছামীমের মৃত্যুর খবর তার গ্রামে পৌঁছালে এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি ডিএমখালি মাঝিকান্দি এলাকায় নিয়ে আসা হয়। পরে সকাল ৯ টায় চরভয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়। ছেলের মৃত্যুতে কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন মা জুলেখা বেগম। ছামীমের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরাও।
ছামীমের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে তার মামাতো ভাই আব্দুল্লা হুসাইন। গ্রামে এলে তারা দুজন সময় কাটাতো একসঙ্গে। এমনকি ঢাকায় গেলে আব্দুল্লাকেও বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতো ছামীম। খেলার সাথীকে হারিয়ে কান্না থামছে না হুসাইনের।
ভাগ্নেকে ভীষণ ভালোবাসতেন মামা সাইফুল ইসলামও। ছোট ভাগ্নের এমন করুণ মৃত্যু যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে ভীষণ মেধাবী ছিল আমার ভাগ্নে। ওর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। বাবার মৃত্যুর পর ওকে সবাই আগলে রেখেছিলাম, আজ ও আমাদের ছেড়ে বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায়। ওর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন আজ স্বপ্নই রয়ে গেলো।
সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে এসময় তিনি বলেন, বিমান প্রশিক্ষণের জন্য খোলা ময়দান রয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততম এলাকায় যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, সেই জায়গায় কীভাবে বিমান প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া হলো। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আবরার বলেন, আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, নিহতের সঠিক সংখ্যা লুকানো হচ্ছে। আমরা চাই নিহতদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ্যে আসুক। এছাড়া তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ বের হয়ে আসুক। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে, সেজন্য সরকার কঠিন পদক্ষেপ নিবে এটাই আশা করি। আর কোনোদিন যাতে এভাবে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
আহাজারি করতে করতে জুলেখা বেগম বলেন, আমার বাবা বলছিল হাসপাতাল এতো দূরে কেন। কাছাকাছি হাসপাতাল হতে পারে না। আমাকে তোমরা চিকিৎসা করাতে বিদেশে নিয়ে যাও। আমার বাবা বাঁচতে চাইছিল। কেন আমার বাবা এভাবে চলে গেলো।
ভেদরগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন,’এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমরা শোকাহত পরিবারের পাশে আছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।’