নাবিল গ্রুপ, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, বর্তমানে মানি লন্ডারিং এবং ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে— তারা দেশের অর্থনীতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। এই গ্রুপের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, তা শুধুমাত্র অর্থপাচার এবং ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করা নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর অর্থনৈতিক দুর্নীতির চিত্র।
ঋণ জালিয়াতি: গ্রুপটির অর্থনৈতিক অপতৎপরতা
নাবিল গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো—তারা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছে। জানা গেছে, ব্যাংকের চারটি শাখা থেকে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। এই ঋণ নেওয়া হয়েছে কোনো নিয়ম-নীতি, আইন বা পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়া। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি এক ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ঋণগুলো আদতে কারা নিয়েছেন, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, এসব প্রশ্ন এখনো নিরসিত হয়নি। তবে এর পেছনে যে কোনো ধরনের দুর্নীতি এবং আইনের চরম লঙ্ঘন রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ: টাকা পাচার এবং অস্বচ্ছ লেনদেন
নাবিল গ্রুপের মালিকদের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো— তারা একাধিক লেনদেনে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করার অভিযোগে অভিযুক্ত নয়, বরং দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে সম্পদ গোপনে স্থানান্তরিত করার কাজও করেছে। এই লেনদেনগুলো সাধারণ জনগণের জন্য অস্বচ্ছ এবং আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব সহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এই ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাপক পরিমাণ অর্থের লেনদেন করেছেন। বিএফআইইউ এমনকি তাদের ব্যাংক লকারও জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ব্যক্তিগত হিসাব এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততা
এনিয়ে একটি চিঠি দিয়ে বিএফআইইউ দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জানায় যে, মো. আমিনুল ইসলামের এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রাখা হোক। চিঠিতে তাদের বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ের হিসাবও স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, যদি কোনো লকার সুবিধা থাকেও, তা জব্দ করা হবে।
এমনকি বিএফআইইউ এই ব্যক্তিদের এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এক্সেল শিট ফরম্যাটে ডেটা পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছে। এই চিঠির মাধ্যমে এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নাবিল গ্রুপের মালিকদের মধ্যে এমন অস্বচ্ছ এবং সন্দেহজনক লেনদেনের ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক তদন্ত: আইনগত ব্যবস্থা
নাবিল গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষত, যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে নাবিল গ্রুপের বিদেশি অংশীদারের বিরুদ্ধে চলমান মামলা এবং এসব অভিযোগের তদন্তে চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সুরক্ষায় এ ধরনের মামলার তদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিচারপতি স্যার রবার্ট জে এই প্রসঙ্গে বলেন, “আপনার ক্লায়েন্টরা এমন অবস্থায় পড়েছে, আমাদেরকেও বিব্রত করতে বাধ্য হতে পারে।”
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থা এই বিষয়গুলোতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কাজ করছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে এই দুর্নীতির জাল উন্মোচন করতে হবে।