মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট লাইনের ওপর গতকাল পরপর ছয়টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ঢাকার জন্য একটি কঠিন সতর্কবার্তা। কারণ বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত এবং বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ পড়ে। এটি তিনটি টেকটোনিক প্লেট—ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনের অংশ, যা বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় হুমকি। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এই অঞ্চলে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শক্তি জমা হচ্ছে, যা যে কোনো সময় ৯ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে।
গতকালের ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা ছিল ৪.৫ থেকে ৭.৭ পর্যন্ত, যা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন ভবনের ক্ষতি করেছে। এখন পর্যন্ত ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল বার্মা প্লেটের ওপর ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে বাংলাদেশও বড় বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলে ২৮টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ৪১-এ দাঁড়ায় এবং ২০২৪ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৫৪। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা বড় ধরনের কম্পনের পূর্বাভাস হতে পারে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তির সময়কাল ১২৫ থেকে ১৭৫ বছর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এটি ২৫০ থেকে ৩০০ বছর। বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাসও তা-ই বলে। ১৭৬২ সালে চট্টগ্রামে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, ১৮৬৯ সালে চাছাড়ে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালে ভারতের বিশাল ভূমিকম্প (৮.৭ মাত্রা), ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পসহ বেশ কয়েকটি বড় ধরনের কম্পন এখানে হয়েছে। এই তথ্যগুলো বলছে, বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা খুবই বাস্তব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে ঢাকাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভূমিকম্প বিপর্যয় ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের ২০টি সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানোর জন্য অবিলম্বে টেকসই ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটলে হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, ভবনসহ সবকিছু ধসে পড়তে পারে। সেজন্য ভূমিকম্প মোকাবিলায় অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা, জরুরি উদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করা এবং জনসচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।