গত পর্বে সিক্রেট আইজের দর্শকদের মোহাম্মদপুরের অপরাধ জগতের অন্ধকার চিত্রের একাংশ দেখানো হয়েছিল। যেখানে রাজত্ব করতেন কব্জি কাটা আনোয়ার, যিনি বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। তবে, আজকের এই পর্বে আমাদের লক্ষ্য তার পেছনের শক্তিশালী শক্তিগুলোকে তুলে ধরা। এই শক্তির কারণেই তো অপরাধের ঘোড়া এতটা লাগামহীনভাবে ছুটে চলছিল। আসুন, দেখুন আনোয়ারের সৃষ্টিকর্তারা কারা এবং কিভাবে এই অপরাধ জগতের বিস্তার ঘটেছিল।
একটি নাম উঠে আসে, যা এই অপরাধ জগতের ভেতর অনেকটা কালো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে – কালা মনির। তার পুরো নাম মনিরুজ্জামান মনির। সিক্রেট আইজ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মনির দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির ছায়ায় ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করে আসছিলেন। তার মূল কেন্দ্র ছিল মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ঢাকা উদ্যান এলাকা। তবে এই ক্ষমতার জন্য তাকে শুধু কব্জি কাটা আনোয়ারের মতো সাহসী হতে হয়নি, তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ও প্রয়োজন ছিল।
মনিরের প্রভাব রাজনীতিতে ছিল ব্যাপক। স্থানীয় রাজনীতির আশ্রয়ে সে দ্রুত অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। ২০১৯ সালে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব গ্রেফতার হওয়ার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও, মনির দ্রুত ফিরে আসে এবং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে আসীন হয়ে সে অপরাধমূলক কার্যক্রম আরও বাড়িয়ে দেয়।
এত বড় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মনির শুধু যে অপরাধ করতো, তা নয়। তার মায়েরও অপরাধ জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মনিরের মা সাবিহা খাতুন পুরো অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন যখন মনির গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তার নির্মম বর্বরতার শিকার ছিলেন এক ভুক্তভোগী নাজিম। তিনি অভিযোগ করেন যে, মনির বাহিনী প্রথমে তার বাড়ি দখল করে এবং পরে ১ লাখ টাকা চাঁদার বিনিময়ে সেটা ফিরিয়ে দেয়। এমনকি চাঁদাবাজির লেনদেনের সময় স্ট্যাম্পে লেখালেখি করেও চাঁদা নেয়া হত—এ যেন আত্মবিশ্বাসের সাথে চাঁদাবাজি।
মনিরের অপরাধের এক ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল তুরাগ নদের তীরে অবৈধভাবে নির্মিত তার বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। এখানে তাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে ধরিয়ে এনে শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো, এবং বাইরে শব্দ না যেতে এজন্য উচ্চস্বরে গান বাজানো হতো।
অন্যদিকে, শামীম ব্যাপারী নামক এক অপরাধীও এই অপরাধ জগতের অন্যতম হোতা। মোহাম্মদপুরে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, জমি দখল, ছিনতাইসহ ভয়ঙ্কর অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তার নির্দেশেই আনোয়ার বাহিনী বুড়িগঙ্গা ফিলিং স্টেশন দখল করে। শামীম ব্যাপারী ২০০৩ সালের বরকত হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন এবং দীর্ঘ ১৯ বছর ভারতে পলাতক ছিলেন। ভারতীয় নাগরিকত্বও কৌশলে গ্রহণ করেছিলেন তিনি, কিন্তু তার অপরাধ কার্যক্রম বাংলাদেশে সক্রিয় ছিল।
শামীমের রাজনীতি ও অপরাধের সখ্যতা অনেক গভীরে। তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সায়েম শাহীনের সহোদর এবং সাবেক কাউন্সিলর আবু সাঈদ ব্যাপারীর ছেলে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে শামীমের অপরাধ কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমনকি ২০১৩ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার উপর হামলা চালানোর জন্য তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। এই ঘটনায় মামলায় শামীমের নামও আসে, এবং পরবর্তীতে তাকে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আজকের অনুসন্ধানে আমরা যে নামটি সামনে পেয়েছি, তা আরও এক বিস্ময়কর তথ্য তুলে ধরেছে। শামীম ব্যাপারীর এক ভারতীয় সংযোগ রয়েছে। এই ব্যক্তি সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জী, একজন র’ এজেন্ট, যিনি কলকাতায় বসবাস করেন। তার সাথে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তথ্য পাওয়া গেছে, এবং তিনি ভারতীয় সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় হাত বাড়িয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এইসব ঘটনার পিছনে যারা আছেন তারা কি শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনার অংশ? না, এগুলো একটি জাল, যার অনেক কড়া সুতো একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে। প্রশ্ন আসে—এত বছরের পরও কেন আমাদের প্রশাসন এই জালের মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি? কেন অপরাধীরা অবাধে ভারতে পালিয়ে যায়? কেন এত সখ্যতা? দেশের বর্তমান সরকার কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করবে?