গবি সংবাদদাতা
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে মনোনয়ন নেওয়া একাধিক প্রার্থীর রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
প্রার্থীদের তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে মনোনয়ন নিয়েছেন ১০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু এদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
গকসুর গঠনতন্ত্রের ১৭(খ) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে—কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনে যোগ দিলে বা ওই সংগঠনের পদে থাকলে প্রার্থীর সদস্যপদ বাতিল হবে। তবে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন বলছে, লিখিত অভিযোগ বা প্রমাণ না থাকায় এখনই কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি।
এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ের শিক্ষার্থীরা প্রার্থী হচ্ছেন?
রাজনৈতিক সংযোগে থাকা ভিপি প্রার্থীরা
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ক্যাম্পাসে কমিটি গঠন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সেই কমিটির সভাপতি মো: নির্জন গকসু নির্বাচনের ভিপি পদের মনোনয়ন নিয়েছেন। তিনি আইন বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।
নির্জন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের একটি কমিটি থাকলেও প্রশাসন সেটিকে বৈধতা দেয়নি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কোনো দলীয় কার্যক্রম করিনি। দীর্ঘ সাত বছর পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সুযোগ। গঠনতন্ত্রে শুধু দলীয় রাজনীতি নয়, আরও নানা বিষয়ে কথা বলেছে—সব আইন কি মানা হচ্ছে? একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমারও তো প্রার্থী হওয়ার অধিকার আছে। তিনি যোগ করেন, শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবেন এবং তারা যদি দলীয় রাজনীতি না চান তবে তিনিও তা সমর্থন করবেন না।
একই বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী, ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খোদার নুর রনি মনোনয়ন নিলেও শিক্ষাবিরতির কারণে প্রাথমিকভাবে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন।
আইন বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের আরেক শিক্ষার্থী রাকিব মুসুল্লি। তিনিও ভিপি পদে লড়ছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ঘনিষ্ঠ ’জয় বাংলা’ ক্লাবের সভাপতি, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি, নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতেন। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে এসকল অভিযোগ সহ বিভিন্ন সম্পৃক্ততার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাকিবের দাবি, জয়বাংলা ক্লাব একটি ক্রীড়া সংগঠন, রাজনৈতিক নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় এমপি মহিবুর রহমান মহিবের সঙ্গে পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্রে একবার তার নির্বাচনে কাজ করতে হয়েছিল। এটা নৌকা প্রতীকের কারণে নয়, উনি যেকোনো প্রতীকে আসলেও একইভাবে করতাম। স্থানীয় ভাইস চেয়ারম্যান আমাকে সন্তান বলে সম্বোধন করতেন, যোগাযোগ থাকলেও কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ‘আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠনের সঙ্গেও কখনো যুক্ত ছিলাম না। উল্টো আমি সক্রিয় ভাবে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছি, আমার সহযোদ্ধারা সাক্ষী’ যোগ করেন তিনি।
আরেক প্রার্থী রাজিব হোসেন ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের কর্মী হিসেবে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতেন। তবে জুলাই আন্দোলন চলাকালে তিনি আন্দোলনের পক্ষে ভূমিকা রাখেন। তিনি ফলিত গণিত বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।
রাজিব জানান, তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে কোনো পদে ছিলেন না। “আমাদের গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, পদধারীরা নির্বাচন করতে পারবে না। আমি সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলামের নির্বাচনে কাজ করেছিলাম, কিন্তু তখন তিনি অপরাধে জড়াননি। পরে যখন জুলাই আন্দোলন শুরু হয়, তখন তাদের বিপক্ষে আমিই প্রথম দাঁড়াই। আমি ন্যায়ের পক্ষে ছিলাম এবং স্থানীয় শক্তির বিরুদ্ধেও আন্দোলনে সবাইকে সম্পৃক্ত করি। ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। আমার শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকা পর্যন্তও আমি এর বিরোধিতা করব।”
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সম্পৃক্ততা র অভিযোগ উঠেছে অপর ভিপি পদপ্রার্থী নাসিমের বিরুদ্ধে। তিনি রসায়ন বিভাগের ৭ম সেমিস্টারে অধ্যায়নরত।
এ প্রসঙ্গে নাসিম বলেন, “ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। চরম আওয়ামী দুঃশাসনের মধ্যেও আমি আওয়ামী বিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছি। সেই সময় থেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিটি শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। বহু আন্দোলনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অংশ নিয়েছি, বক্তব্য রেখেছি; তবে কোনো বিশেষ দলীয় কার্যক্রম বা এজেন্ডা বাস্তবায়নে কখনো যুক্ত হইনি।”
তিনি আরও জানান, ৫ আগস্টের পর গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) গঠিত হলে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছিল। “কিন্তু আমিসহ প্রায় ৩৫ জন সেদিনই প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করি,” বলেন তিনি।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আরেক প্রার্থী ইয়াসিন আল মৃদুল দেওয়ান। তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। তিনি সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ এর কর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাতেও সরব উপস্থিতি ও সদ্য গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগ নেতা ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন বলেও জানা যায়।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগ নেতা ইমন আমার আপন ফুপাতো ভাই। তিনি ছাত্রলীগ করতেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা মুরাদ জংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আত্মীয়তার কারণে অনেক সময় তার কথা ফেলতে পারিনি, তাই সর্বোচ্চ এক-দুবার দলীয় কর্মসূচিতে যেতে হয়েছে।”
অভিযোগকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, কোনো পদ-পদবিও নেই। বরং জুলাই আন্দোলনেও আমি সক্রিয় ছিলাম। ইমন ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে বিভিন্ন মহলে আমার বিরুদ্ধে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে।”
আইন বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের প্রার্থী রিফাত আল মুক্তাদির। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে তিনি জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বিভিন্ন সময়ে নিজ ফেসবুক প্রোফাইলে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।
পারিবারিক রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে রিফাত জানান, আমার পরিবার রাজনীতির সাথে জড়িত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না। একজনের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে, তবে আমি তো কোনো রাজনৈতিক দলের পদে ছিলাম না! আমি কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগামীও নই। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে আমার সম্পৃক্ততা কেউ প্রমাণ করতেও পারবে না। কেউ যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি দেখাতে পারে, আমি গকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবো।
এদিকে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় প্রার্থীতা বাতিল হবে কিনা প্রশ্নে রিটার্নিং অফিসার, উপাচার্য ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্যও দেননি তারা।
রিটার্নিং অফিসারের দপ্তর থেকে জানানো হয়, যেসকল তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থীকে যোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। এখানে আলাদা কোনো তথ্য সংযোজনের এখতিয়ার আমাদের নাই। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা কোনো শাস্তি প্রাপ্ত সহ এমন কোনো তথ্য থাকলে তা নিশ্চিত করবে প্রশাসন (রেজিস্ট্রার)। তাদের পক্ষ হতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের যোগ্য বলা হয়েছে।
লিখিত অভিযোগের ব্যপারে তারা জানান, কারো বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ আসেনি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: আবুল হোসেন বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অফিশিয়াল সম্পৃক্ততার তথ্য নেই।
তিনি জানান, তাদের কার্যক্রম মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কখনো দেখা যায়নি। তবে বাইরে তারা বিভিন্ন দলে যুক্ত হতে পারে, সেটি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো হয়, তাহলে প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
উপাচার্য আরও বলেন, বিষয়টি আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পর্যালোচনা করেছি। কোনো প্রমাণিত বা অফিশিয়াল তথ্য ছাড়া তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনগত ভিত্তি নেই। তাই তাদের প্রার্থীতা বাতিল করার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই। এটি সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত।