মাহতাবুর রহমান মাসুম।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পিবিএস) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান দ্বন্দ্ব এবং স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে পল্লী বিদ্যুতের কর্মপরিবেশ ভয়াবহ অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছে। বিশেষ করে শাস্তিমূলক বদলি এবং চাকরিচ্যুতি নিয়ে কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গত দুই মাসে পল্লী বিদ্যুতের মোট সাত জন লাইনম্যান কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতের মধ্যে পাঁচজন শাস্তিমূলক বদলির পর অপরিচিত পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনার শিকার হন। পল্লী বিদ্যুতের এক অভ্যন্তরীন সূত্র জানায়, “বদলি হওয়ার পর নতুন এলাকায় কাজ করতে গিয়ে লাইনম্যানরা অপরিচিত পরিস্থিতিতে পড়ছেন, যার ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না।”
সর্বশেষ, পল্লী বিদ্যুতের চাকরিচ্যুত সহকারী পরিচালক (এজিএম) রাজন কুমারকে মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে পুনরায় জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পিবিএসের কর্মচারীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও হতাশা বিরাজ করছে।
এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাবে পিবিএস ও আরইবির মধ্যে দ্বন্দ্ব লম্বা হচ্ছে, যার ফলেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। সরকারের দমনমূলক ভূমিকা এবং গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির আট মাস পার হলেও প্রতিবেদন না দেওয়া এই সংকট আরও গভীর করেছে।”
বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিন্ন চাকরিবিধি প্রণয়ন, চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মীদের চাকরির স্থায়ী নিয়মকানুন গঠন এবং শাস্তিমূলক বদলির নীতি বাতিল ছাড়া সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে, একটি প্রভাবশালী বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, “অস্থিরতার কারণে গ্রাহক সেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতা এবং কর্মীদের অমিল কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে গুণগত মানের অবনতি ঘটছে।”
পিবিএস বর্তমানে ৮২টি সমিতির মাধ্যমে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এই বিশাল পরিসরে নিরাপদ ও দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার জন্য কর্মপরিবেশের স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, “যদি শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা না আনা হয়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা রোধ না করা হয়, তাহলে বিদ্যুৎ সেবায় বড় ধরনের বিপর্যয় আসা অনিবার্য।”
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এক কর্মচারী নাম গোপন রেখে জানালেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই শাস্তিমূলক বদলির শিকার হচ্ছি, যেখানে কাজের পরিবেশ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা খারাপ। এর ফলে আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে এবং কর্মজীবন কঠিন হয়ে উঠছে।”
সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। পল্লী বিদ্যুতের একাংশের মধ্যে ভয় প্রকাশ করা হচ্ছে, “অস্থিরতা আরও বেড়ে গেলে সেবা সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে এবং বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।”
⸻
প্রেক্ষাপট:
২০১০ সালের পর থেকে পিবিএস ও আরইবির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় চাকরি, পদোন্নতি, নিয়োগ, বদলি এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে পিবিএসের কর্মীরা তাদের বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি দীর্ঘ আট মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন দাখিল না করায় সমাধানের কোনো সুফল আসেনি।
বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পরামর্শে আরইবিকে বাণিজ্যিক খাতে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে, যা কর্মীদের একাংশ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিরোধ ও অসন্তোষের কারণ।
⸻
আরইবির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নিম্নমানের মালামাল ক্রয়ের অভিযোগ
পিবিএসের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আরইবির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিম্নমানের মালামাল ক্রয়ে লিপ্ত রয়েছেন, যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ক্রমাগত প্রক্রিয়াগত বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এবং গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। এই দুর্নীতি ও অসংগতি বিদ্যুৎ খাতের কর্মপরিবেশকে অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
এক বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষক জানান, “দুর্নীতির কারণে যন্ত্রপাতি দ্রুত নষ্ট হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে এবং এর ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে অনিয়ম ও গুণগতমানের অবনতি ঘটছে।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের সংকট ও সেবাবিধানে ব্যাঘাত আসা অনিবার্য।