দীর্ঘ একযুগ ধরে গুম হওয়া প্রভাবশালী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে মেজর জিয়াউল আহসানের সেই সময়ের কথায়। যেখানে জিয়াউল বলেছিলেন, ‘শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।’
মূলত ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে তুলে নেয়। এরপর ইলিয়াস আলীর পরিবার দীর্ঘ এক যুগ ধরে সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দপ্তরে যোগাযোগ করেও ইলিয়াস আলীর হদিস পাননি।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর ইলিয়াস আলী গুম রহস্য আবারও আলোচনায় আসে।
সম্প্রতি এই ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া গ্রেপ্তার র্যাব সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলামের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে।
তাহেরুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার পর দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইলিয়াস আলী সভা করেন তৎকালীন শেরাটন হোটেলে (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল)। সভা শেষ করে রাত ১১টায় তিনি বের হন এবং গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। ওই দিন জিয়াউল আহসানের নির্দেশে শেরাটন হোটেল থেকে তিনি ইলিয়াস আলীকে অনুসরণ করেন। মহাখালী পৌঁছার পর জিয়াউল আহসান নিজেই আরেকটি টিম নিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ করেন। ইলিয়াস আলীর গাড়ি বনানীর ২ নম্বর সড়কের বাসার সামনে পৌঁছার আগেই বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও অপহরণ করা হয়।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেছেন, আমার দায়িত্ব ছিল শেরাটন থেকে অনুসরণ এবং বেতার বার্তায় গতিপথ জিয়াউল স্যারকে জানানো। মহাখালী পৌঁছার পর ইলিয়াস আলীর গাড়ি সরাসরি অনুসরণ শুরু করেন জিয়ার টিম। পরে মহাখালী জলখাবার হোটেলের অদূরে বনানীর ২ নম্বর সড়কে ইলিয়াস আলীর গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে থামানোর পর ড্রাইভার আনসারসহ ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করে জিয়া টিমের সদস্যরা।
এরপর জিয়া বলেন, ‘তোমার ডিউটি শেষ, চলে যাও।’ নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে যান। জিয়ার টিম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারবেন না।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র অনুযায়ী, ইলিয়াস আলীকে হত্যা ছাড়াও র্যাবের জিয়াউল আহসানের কিলিং স্কোয়াডের এক সদস্য একদিনে ১১ জন এবং আরেক সদস্য ১৩ জনকে খুন করেছিল। সেই সময় জিয়াউল আহসান র্যাবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও গুম তদন্ত কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত দুজন সেনাসদস্য বর্তমানে সেনাবাহিনীতে রয়েছেন।
এরা হলেন, ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া ও ইমরুল। জিয়াউল আহসানের রানার হিসেবে গুম ও খুন মিশনের হুকুম তারা তামিল করতেন। খুনিচক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর গুম তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিমের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী এ দুই সদস্যকে ক্লোজড এবং অন্তরীণ করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পর তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হওয়া জিয়াউল আহসান অফিসে ফিরে স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ বড় একটি অপারেশনে সাকসেসফুল হলাম। শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।’
জিয়া এ কথাও বলেন যে, ইলিয়াস আলী অপারেশনের কথা ঊর্ধ্বতনকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন বলতে তিনি মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকি কিংবা শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন বলে সূত্রের ধারণা। যাদের সামনে এই কথা জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তাদেরকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম।
গুম তদন্ত কমিশন সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইলিয়াস আলীকে গুম এবং খুন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এসএসএফ-এর মহাপরিচালক ছিলেন লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সওরাওয়ার্দী। তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডিজিএফআইর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
তথ্যসূত্র : দৈনিক আমার দেশ