একজন মা প্রতিদিন ভোরে জেগে ওঠেন, তাকিয়ে থাকেন দরজার দিকে। এই বুঝি সেই চেনা কণ্ঠে ডাক পড়বে, ‘মা, ভাত দাও!’ কিন্তু সেই কণ্ঠ দেশের সীমানা পেরিয়ে এখন পাশের দেশের কারাগারে। এক অজানা ঘেরাটোপে বন্দি। ছেলে নেই, ঘরটা যেন প্রাণহীন। ছেলের নাম আবদুল মান্নান। বয়স মাত্র ২১।
গত ১৬ এপ্রিল বিকালে সিলেটের গোয়াইনঘাটের বেউরঝারী সীমান্তে বেড়াতে গেলে ভারতের বড়বিল্লাহ বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা মান্নানসহ আরও তিন যুবককে আটক করে। এরপর তাকে ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডাউকি থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টের ১৪ ধারায় মামলা রুজু করে তাকে জোয়াই কারাগারে পাঠিয়েছে।
আটককৃত মান্নান কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ধামতী ইউনিয়নের পদুয়া গ্রামের হাজী বাড়ির ছেলে। তার বাবা মো. মজিবুর রহমান মারা গেছেন অনেক আগে। সংসারের বড় ছেলে আব্দুল হান্নান তার ছোট ভাই বিল্লালকে(১৬) নিয়ে ঢাকা ফতুল্লা এলাকায় একটি চা দোকানে কাজ করেন। লেখা পড়া করা একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ছেলেটিই(মান্নান)। নোয়াখালী চন্দ্রগঞ্জ পূর্ববাজারের বদ্ধবাড়িপুল এলাকার একটি মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগে লেখাপড়া করেন।
মান্নানের বড় ভাই হান্নান জানান, তার ভাই গত ১৬ এপ্রিল নোয়াখালী মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে তার ভাই ভারত থেকে ফোনে জানায়, সে তার আরো তিন বন্ধুকে নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল বিকালে ভুল করে সিলেট গোয়াইনঘাটের বেউরঝারী সীমান্ত দিয়ে বেড়াতে গিয়ে বিএসএফ’র কাছে আটক হয়ে এখন কারাগারে আছে।
তিনি আরো জানান, ফোনে ভারত থেকে একজন আইনজীবী পরিচয়ে অনেক কথা বলেন এবং ম্যাসেঞ্জারে লিখে জানান, ‘আমি একজন আইনজীবী, বিদেশে জামিন দেয়ার কাজে আমি বিশেষজ্ঞ, আপনার আত্মীয় আব্দুল মান্নান বর্তমানে জোয়াই জেলা কারাগারে বন্দী। যদি আমরা তার মুক্তির জন্য জামিনের আবেদন না করি, তাহলে তাকে তাহলে তাকে প্রায় ৪-৫ বছর ধরে কট্টর অপরাধীদের সাথে জেলে কাটাতে হবে। তার মুক্তির জন্য ৯০,০০০ টাকা ভারতীয় মুদ্রা চার্জ করতে হবে। আমি ২০,০০০ টাকা অগ্রিম নেব এবং সমস্ত কাজ সম্পন্ন হলে এবং জামিন সফল হলে বাকি টাকা আমি নেব। দয়া করে এটি জরুরি বিবেচনা করুন।
ওই আইনজীবীর কাছে জানতে চাই, ‘তাকে কোন অভিযোগে আটক করা হয়েছে? তার মামলার নথি দেন। বিষয়টি পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে, টাকা পাঠাবার প্রক্রিয়া কি তাও জানাবেন।
তার জবাবে ওই আইনজীবী জানান, ‘অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের জন্য তাকে ১৯৪৬ সালের বিদেশী আইনের ১৪ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদি টাকা প্রস্তুত থাকে, তাহলে আপনাকে তা বাংলাদেশে আমার এক বন্ধুর কাছে পাঠাতে হবে এবং তিনি তা ভারতে পাঠাতে সাহায্য করবেন।’
এ ব্যপারে শরীফুল আলম চৌধূরী নামে এক সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করেন। ওই সাংবাদিক বিজিবির ৫০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল তানজীম আহম্মেদ’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানিয়েছেন, মান্নান সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করায় বিএসএফ তাকে আটক করেছে। এরপর অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতীয় পুলিশ তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে।
ওই সাংবাদিক বিষয়টি নিশ্চিত হতে ভারতীয় হাই কমিশনারের নাম প্রকাশে এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। ওই কর্মকর্তা জানান, ভারতে অনেক প্রতারক আছে। আসামী জামিন কিংবা ছাড়িয়ে আনার ক্ষেত্রে কারোর সাথে টাকা লেনদেন করবেন না। বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশ হাই কমিশনারের মাধ্যমে চিঠি চালাচলির মাধ্যমে করতে হবে।
মঙ্গলবার দুপুরে এ খবর শোনার পর থেকেই মান্নানের মা আয়েশা বেগমের ঘরে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। বুকফাটা আর্তনাদে তিনি বলেন, ‘আমার মান্নান কোনো অপরাধী না। সে তো ঘুরতে গিয়েছিল। ওর কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন, আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না।’
দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে আয়েশার একটাই অনুরোধ ‘মান্নানকে ফিরিয়ে আনুন। আমি শুধু আমার ছেলেটাকে চাই, জীবিত চাই!’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায়ই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, কিন্তু এই ঘটনাগুলোর মানবিক দিক যেন অনেক সময় হারিয়ে যায় কূটনৈতিক কড়াকড়িতে। মান্নানের ঘটনা যেন সেই একই গল্পের নতুন অধ্যায় না হয় এই প্রার্থনাই আজ একজন অসহায় মায়ের।
আবদুল মান্নানের দ্রত মুক্তির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রত পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে তার এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।