মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫

সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে হাসনাতের বক্তব্যের দ্বিমত করলেন সারজিস

নিজস্ব প্রতিবেদক
-বিজ্ঞাপণ-spot_img

দেশের রাজনৈতিক আলাপে এ মুহূর্তে উঠে এসেছে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কিত বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্ট। সেখানে তিনি বৈঠকে হওয়া বেশ কিছু কথোপকথন এবং তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। বৈঠকে হাসনাতের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের উত্তরাঞ্চলের সংগঠক সারজিস আলম। এবার তিনিও সেই বৈঠক নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরলেন।

রোববার (২৩ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন সারজিস। সেখানে হাসনাতের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেন তিনি।

সারজিস আলম বলেন, সেদিন আমি এবং হাসনাত সেনাপ্রধানের সাথে গিয়ে কথা বলি। আমাদের সাথে আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন সদস্যেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারেননি। প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখি সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজারের সাথে যখন প্রয়োজন হতো তখন মেসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো।

এনসিপির এই নেতা লেখেন, যেদিন সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে অনেকটা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিলেন এবং বললেন ‘এনাফ ইজ এনাফ’ তখন আমি সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইসরকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদের দৃষ্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখছেন কিনা? সেনাপ্রধানের বক্তব্য তুলনামূলক straight-forward এবং harsh মনে হচ্ছে।তিনি আমাকে বললেন, তোমরা কি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাও? আমি বললাম- বলা যেতে পারে। এরপরে সেদিন সেনাপ্রধানের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় । সেনাভবনে সেই রুমে আমরা তিনজনই ছিলাম। সেনাপ্রধান, হাসনাত এবং আমি।

মানুষ হিসেবে যেকোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে আমার সেক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে।

সেদিনের প্রেক্ষাপট নিয়ে সারজিসের ভাষ্য, আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি ‘প্রস্তাব’ দেয়ার আঙ্গিকে দেখি না বরং ‘সরাসরি অভিমত প্রকাশের’ মতো করে দেখি। ‘অভিমত প্রকাশ’ এবং ‘প্রস্তাব দেওয়া’ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও পূর্বের তুলনায় সেদিন সেনাপ্রধান অনেকটা স্ট্রেইথ-ফরোয়ার্ড ভাষায় কথা বলছিলেন । পাশাপাশি ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের জন্য ‘চাপ দেওয়ার’ যে বিষয়টি এসেছে সেখানে ‘চাপ দেয়া হয়েছে’ এমনটি আমার মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।

সারজিস আরও লেখেন, হাসনাতের বক্তব্যে যে টপিকগুলো এসেছিল, যেমন- “রিফাইন্ড আওয়ামীলীগ, সাবের হোসেন, শিরিন শারমিন চৌধুরী, সোহেল তাজ; এসব নিয়ে কথা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে কিনা, এই ইলেকশনে আওয়ামী লীগ থাকলে কী হবে, না থাকলে কী হবে, আওয়ামীলীগ এই ইলেকশন না করলে কবে ফিরে আসতে পারে কিংবা আদৌ আসবে কিনা এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। এসব সমীকরণে দেশের উপরে কী প্রভাব পড়তে পারে, স্থিতিশীলতা কিংবা অস্থিতিশীলতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেসব নিয়ে কথা হয়েছিল।

কিন্তু যেই টোনে হাসনাতের ফেসবুক লেখা উপস্থাপন করা হয়েছে আমি মনে করি- কনভারসেশন ততটা এক্সট্রিম ছিল না। তবে অন্য কোনো একদিনের চেয়ে অবশ্যই স্ট্রেইথ-ফরওয়ার্ড এবং সো-কনফিডেন্ট ছিল। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ইলেকশনে অংশগ্রহণ করা যে প্রয়োজনীয় সেই বিষয়ে সরাসরি অভিমত ছিল।

সারজিস সেদিনের বৈঠকের ব্যাপারে বলেন, আলোচনার একপর্যায়ে বলি- যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কীভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে,’ ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি।

সারজিসের কথায়, এই কনভারসেশনটা হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু আমাদের রুমে বসে হওয়া কনভারসেশন হঠাৎ এককভাবে শেষ করে যখন সেনাপ্রধান উঠে দাঁড়ালেন এবং রুম থেকে কথা বলতে বলতে বের হয়ে এসে যখন আমরা গাড়িতে করে ফিরবো তার পূর্বে বিদায় নেয়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কনভারসেশন হয়েছে। সেনাপ্রধান রেগে যাওয়ার সুরে এই কথা বলেছেন বলে আমার মনে হয়নি বরং বয়সে তুলনামূলক বেশ সিনিয়র কেউ জুনিয়রদেরকে যেভাবে অভিজ্ঞতার ভারের কথা ব্যক্ত করে সেই টোন এবং এক্সপ্রেশনে বলেছেন।

‘হাসনাত না ওয়াকার’ এই ন্যারেটিভ এবং স্লোগানকে সারজিস প্রত্যাশা করেন না বলেও স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, হাসনাতের জায়গা ভিন্ন এবং সেনাপ্রধান জনাব ওয়াকারুজ্জামানের জায়গাও ভিন্ন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে জাতীয় নাগরিক পার্টি অন্যান্য রাজনৈতিক দল কিংবা জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানো কখনও প্রাসঙ্গিক নয়। পাশাপাশি সেনাপ্রধানের পদত্যাগ নিয়ে যে কথা দুই-এক জায়গায় আসছে সেটিও আমাদের বক্তব্য নয়।

এরপর স্ট্যাটাসের একপর্যায়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করেন সারজিস। তিনি বলেন, আমি ভুল হতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে আমার এটিই সঠিক মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ না কেউ যোগাযোগ রক্ষা করে। সেই প্রাইভেসি তারা বজায় রাখে।

আমাদের সাথে সেনাপ্রধানের যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছে সেগুলোর সাথে আমাদের সরাসরি দ্বিমত থাকলেও আমরা সেগুলো নিয়ে আমাদের দলের ফোরামে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারতাম, সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারতাম। কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের যেকোনো ভার্সনের বিরুদ্ধে এখনকার মতই রাজপথে নামতে পারতাম। অথবা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি আমাদের সাথে ঐক্যমতে না পৌঁছালে আমরা শুধুমাত্র আমাদের দলের পক্ষ থেকেই এই দাবি নিয়ে রাজপথে নামতে পারতাম।

কিন্তু যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সাথে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।

আমার এই বক্তব্যে আমার সহযোদ্ধা হাসনাতের বক্তব্যের সাথে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত এসেছে। এটার জন্য অনেকে আমার সমালোচনা করতে পারেন কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের ব্যক্তিত্ব স্রোতে গা ভাসানোর মত কখনোই ছিল না। ছিল না বলেই আমরা হাসিনা রেজিমের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।

আজও কেউ হাসনাতের দিকে বন্দুক তাক করলে তার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কমিটমেন্ট আমাদের আছে। কিন্তু সহযোদ্ধার কোনো বিষয় যখন নিজের জায়গা থেকে সংশোধন দেয়ার প্রয়োজন মনে করি তখন সেটাও আমি করব। সেই বিবেকবোধটুকু ছিল বলেই ৬ জুন প্রথম যেদিন শহীদ মিনারে কয়েকজন কোটা প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় তাদের মধ্যে সামনের সারিতে আমরা ছিলাম।

পোস্টের শেষে সারজিস বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই বিবেকবোধের জায়গাটুকুই আমাদেরকে সঠিক পথে রাখবে। আত্মসমালোচনা করার এই মানসিকতাই আমাদেরকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যাবে। জুলাই গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো ‘আওয়ামীলীগের যেকোনো ভার্সন’ ও তাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ৮ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চাঁনশিকারী সীমান্ত দিয়ে আটজনকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। আজ মঙ্গলবার (৩ জুন) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এদের পুশইন করে...

গাজীপুরে পোশক শ্রমিকের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ

গাজীপুরের শ্রীপুরে জিন্নাত নীটওয়্যার লিমিটেড কারখানায় জাকির হোসেন নামে এক শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্রে করে শ্রমিক অসন্তোষের দেখা দেয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের পুলিশ নিয়ন্ত্রণে...

বিএনপির সম্মেলনে ভোটার ১৩৫, ভোট পড়েছে ১৫৩

নাঙ্গলকোট পৌর বিএনপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে পুরুষ ভোটার ছিল ১৩৫ জন। অথচ ভোট পড়েছে ১৫৩টি। বাড়তি ১৮টি ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলে এগুলো...

সীমান্ত পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিকস ক্লাব

প্রযুক্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক চর্চার বিষয় হিসেবে পরিচিত। তবে সীমান্তঘেঁষা ছোট জেলা চুয়াডাঙ্গার একদল তরুণ প্রমাণ করেছে- সফলতার জন্য জায়গা নয়, দরকার সাহস, নিষ্ঠা আর...

সম্পর্কিত নিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ৮ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চাঁনশিকারী সীমান্ত দিয়ে আটজনকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। আজ...

গাজীপুরে পোশক শ্রমিকের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ

গাজীপুরের শ্রীপুরে জিন্নাত নীটওয়্যার লিমিটেড কারখানায় জাকির হোসেন নামে এক শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাকে...

বিএনপির সম্মেলনে ভোটার ১৩৫, ভোট পড়েছে ১৫৩

নাঙ্গলকোট পৌর বিএনপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে পুরুষ ভোটার ছিল ১৩৫ জন। অথচ...