এক সময় এই স্থান ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব। পরে পরিণত হয়, দেশের জাতীয় ইতিহাসের গর্বিত স্মৃতিচিহ্নে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, এই উদ্যানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। এখানে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতীয় ঐতিহ্য ও অসংখ্য স্মরণীয় অধ্যায়।
কিন্তু সেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন যেন হয়ে উঠেছে মাদকসেবনের আখড়া। সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই স্থান আজ গাঁজা, ইয়াবা আর মদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন বিকেল থেকে শুরু হয়ে, রাত অবধি এখানে চলে মাদকসেবনের আসর। গাঁজার গন্ধে ছাওয়া থাকে মুক্তমঞ্চ, কালি মন্দির, ছবির হাট, তিন নেতার মাজার সংলগ্ন গলি ও দোয়েল চত্বরের পাশের দোকানগুলোর পেছনের এলাকা। নিয়মিত জড়ো হয় মাদকসেবীরা, চলে উন্মুক্তভাবে গাঁজা ও মদের সেবন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, “এই উদ্যানে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ কেজি গাঁজা বিক্রি হয়। অর্থাৎ মাসে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ মণ। গাঁজাসেবীর সংখ্যা দৈনিক এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এ খাতে প্রতি মাসে প্রায় ২৬ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকার ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক বিক্রি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে—এই বিশাল মাদক কারবার কারা চালায়? শাহবাগ থানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো একেবারে পাশেই, তাহলে তারা কী করছে?”
তুহিন আরও বলেন, “সারা ঢাকায় কিশোর গ্যাং, মাদকসেবী, ছিনতাইকারী—সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে এই উদ্যানেই। তারা এখানে এসে বেপরোয়াভাবে সব কিছু করছে। প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা মাদকসেবীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। এখানে আসা-যাওয়ার সময় চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে চলতে হয়। কেউ যদি প্রতিবাদ করে, তাদের ওপর হামলা হয়। মোবাইল, টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। পুলিশ অনেক সময় দেখেও কিছু বলে না।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়, বাইরের নানা শ্রেণির লোক এসে মাদক সেবন করে। কেউ যেন নির্ভয়ে মাদক গ্রহণ করতে পারে, এমন পরিবেশ গড়ে উঠেছে। অপরাধীরা বুঝে নিয়েছে— এখানে কোনো বাধা নেই, যা খুশি তাই করা যায়।”
এই ভয়ংকর চিত্র এখন শুধু রাজধানীবাসীর জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের মাঝখানে, জাতির ইতিহাসবাহী স্থানে যদি এভাবে মাদক কারবার ও সেবন চলতে থাকে—তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কী দিয়ে রক্ষা করা যাবে?
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের একটাই দাবি—সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে অবিলম্বে মাদকমুক্ত ঘোষণা করে কঠোর অভিযান চালানো হোক। ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করা হোক অপরাধের ছায়া থেকে।