তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩০০ জনে পৌঁছেছে। সোমবার ভোরে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক ও উত্তর সিরিয়ায় হওয়া এই ভূমিকম্পের জেরে এখনও শতাধিক লোক ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সীমান্তের উভয় পাড়ের বাসিন্দারা ভূমিকম্পের পর খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়, কারণ ভূমিকম্পের পর ভবনগুলো ধসে পড়তে থাকে এবং শক্তিশালী আফটারশক চলতে থাকে।
জানা যায়, তুরস্কের একটি হাসপাতাল ধসে পড়েছে এবং সিরিয়ার কয়েকটি হাসপাতাল থেকে নবজাতকসহ অন্যান্য রোগীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তুরস্কের আদানা শহরে বাসিন্দা মুহাম্মেত ফাতিহ ইয়াভুস বলেছেন যে তার বাড়ির কাছে তিনটি ভবন ধসে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, একজন জীবিত ব্যক্তিকে আমি ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে ডাকতে শুনি, তবে আমার গায়ে আর শক্তি ছিল না। পরে উদ্ধারকর্মীরা তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে।
মিশরের কায়রো পর্যন্ত কম্পন অনুভূত হয়েছিল, তুরস্কের প্রাদেশিক রাজধানী গাজিয়ানটেপের উত্তরে ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল।
এটি এমন একটি অঞ্চলে আঘাত হানে যেটি সিরিয়ায় এক দশকেরও বেশি গৃহযুদ্ধের কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিরিয়ার বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো যুদ্ধের কারণে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় চার মিলিয়ন লোকে পরিপূর্ণ। তাদের মধ্যে অনেকেই এমন বিল্ডিংগুলোতে বাস করে যেগুলো অতীতের বোমা হামলায় ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।
হোয়াইট হেলমেট নামে বিরোধী জরুরি সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, শত শত পরিবার ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, হাসপাতালগুলো আহতদের রোগীতে কানায় কানায় পূর্ণ।
এসএএমএস মেডিকেল সংস্থা জানায়, একটি প্রসূতি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতাল খালি করে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
আতমেহ শহরের চিকিৎসক মুহিব কাদ্দুর বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে মৃতের সংখ্যা শতাধিক।’
তুরস্ক প্রায়ই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। ১৯৯৯ সালে উত্তর-পশ্চিম তুরস্কে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সোমবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ৭.৮ পরিমাপ করেছে।
তুর্কিয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পর অন্তত ২০টি আফটারশক হয়েছে।
সিরিয়ার আলেপ্পো ও হামা শহর থেকে তুরস্কের দিয়ারবাকির পর্যন্ত উত্তর-পূর্বে ৩৩০ কিলোমিটার (২০০ মাইল) এরও বেশি বিস্তৃত এলাকায় ভবনগুলো ধসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, তুরস্কের গাজিয়ানটেপ ও কাহরামানমারাস প্রদেশে প্রায় ৯০০টি ভবন ধ্বংস হয়েছে।
তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় শহর ইস্কান্দারউনে একটি হাসপাতাল ধসে পড়েছে, তবে হতাহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
ওকতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, একই সময়ে আমরা অত্যন্ত কঠিন আবহাওয়ার সঙ্গেও লড়াই করছি।’
তিনি বলেন, দুর্যোগ কবলিত এলাকায় প্রায় ২৮০০টি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল মোতায়েন করা হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এক টুইটে লিখেছেন, ‘আমরা আশা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারব।’
তাইওয়ান, রাশিয়া ও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ চিকিৎসা সরবরাহ, অনুসন্ধান দল বা অর্থ সাহায্য পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
তুরস্কের ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করা মানুষেরা ট্র্যাফিক জ্যামের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা জরুরি দলগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের রাস্তায় না নামতে অনুরোধ করেছেন। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের আশেপাশে থাকায় এই অঞ্চলের চারপাশের মসজিদগুলো বাড়িতে ফিরতে না পারা মানুষদের আশ্রয়ের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।
ভূমিকম্পটি গাজিয়ানটেপের সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ককে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, এর ঐতিহাসিক দুর্গটি শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। দুর্গের দেয়াল ও ওয়াচ টাওয়ারের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে এবং অন্যান্য অংশগুলোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দিয়ারবাকিরে শত শত উদ্ধারকর্মী এবং বেসামরিক লোক ধ্বংসস্তূপ থেকে আটকে পড়া জীবিতদের খোঁজে অনুসন্ধান চালায়।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ভূমিকম্পটি ইদলিব প্রদেশের কয়েক বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা এবং রাশিয়ান ও সরকারি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত ছিটমহলবাসীদের দুর্দশা আরও বাড়িয়েছে।
খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সবকিছুর জন্য অঞ্চলটি পাশের তুরস্ক থেকে পাওয়া সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স সেখানকার পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
তুরস্কের সীমান্তবর্তী পাহাড়ের সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ছোট শহর আজমারিনে কম্বলে মোড়ানো বেশ কয়েকটি মৃত শিশুর লাশ উদ্ধার করে একটি হাসপাতালে আনা হয়েছিল।
ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল গাজিয়ানটেপ থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার (২০ মাইল) দূরে। এটি ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীর ছিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতে, তুরস্কের ১০টি প্রদেশে কমপক্ষে ৯১২ জন নিহত এবং ৫৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মৃতের সংখ্যা ৩২৬ জনে পৌঁছেছে এবং প্রায় ১ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
হোয়াইট হেলমেট অনুসারে, বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছে।
যদিও এসএএমএস চিকিৎসা সংস্থা নিহতের সংখ্যা ১০৬ জন বলে জানিয়েছে, তবে তারা স্বীকার করেছেন যে শত শত মানুষ আহত হয়েছেন।
দামেস্কে ভবনগুলো যখন কেঁপে ওঠে বহু মানুষ তখন ভয়ে রাস্তায় নেমে আসে।
লেবাননের বাসিন্দারাও ভূমিকম্প অনুভব করেন এবং প্রায় ৪০ সেকেন্ডের জন্য সেখানকার ভবনগুলো কোপতে থাকে।
এসময় বৈরুতের অনেক বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিল বা তাদের গাড়িতে করে বিল্ডিং থেকে দূরে চলে গিয়েছিল।
২০২০ সালের বন্দর বিস্ফোরণের স্মৃতি তাদের আতঙ্কিত করেছিল, যে দুর্ঘটনায় শহরটির বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তুরস্কের হাতায় প্রদেশের একজন মন্ত্রী হুসেইন ইয়ামান বলেছেন, তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য তাদের ধসে পড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন।
তিনি টেলিফোনে হ্যাবারতুর্ক টেলিভিশনকে বলেন, ‘আরও অনেক লোক আটকা পড়েছে। এখানে অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শীতকালেও মানুষ রাস্তায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে, এরমধ্যে আবার বৃষ্টি হচ্ছে।’