বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর প্রভাব দেশের সাধারণ মানুষের ওপর প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এমনকি সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুরাও ঋণের ভারে জর্জরিত হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণের সুদ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, আর ২০২৪ সালের জুন মাসে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ঋণভার প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রায় ১ লাখ টাকা, যার মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং দেশি ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা, কারণ গত ৪ বছর আগে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এককথায়, এই ঋণ কোনো একক ঘটনা নয়, বরং একটি দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ফলাফল।
এই ঋণের বিশাল পরিমাণের প্রধান কারণ হলো দেশীয় এবং বিদেশী উভয় ধরনের ঋণের সমন্বয়। বাংলাদেশের সরকার, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু, ঋণের সুদের চাপ এবং ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারের অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশীয় অর্থনীতি ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের এই ঋণভার শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের ওপরই নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপরও চাপ ফেলছে। সদ্য জন্ম নেওয়া একটি শিশু আজও এই ঋণভার বয়ে বেড়াবে। ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণের চাপ দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধে ব্যয়িত হয়, তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সরকারের মনোযোগ কতটুকু থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।বিশ্বব্যাপী দেখা যায়, যেসব দেশ ভালোভাবে ঋণ পরিচালনা করে, তারা তাদের নাগরিকদের জন্য উন্নত সুবিধা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, সরকারের ঋণের ব্যয় ভার এবং এর সুদ পরিশোধের কারণে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের জনগণের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবকাঠামো এবং মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক তেমনভাবে অগ্রসর হচ্ছে না।
ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, সেখানে ৫৯ শতাংশ কর আদায় হয় সরাসরি কর থেকে, যেখানে বাংলাদেশে এই হার ৬৫ শতাংশের কাছাকাছি, যা মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন কর (VAT) হিসেবে আসে। এই উচ্চ করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে আরও কঠিন করে তোলে। যেখানে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সরকারের কাছ থেকে নাগরিকদের এই ধরনের অতিরিক্ত করের বোঝা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এই ঋণের সমস্যা যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। ঋণ পরিশোধে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের প্রকৃত উন্নয়নে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সরকার যদি ঋণের বোঝা কমানোর জন্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ব্যয় সংকোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তবে ভবিষ্যতে দেশের জনগণ আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এর পরিণতি শুধুমাত্র দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দেশের ঋণের সুদ ও পরিশোধের চাপ যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরও কার্যকরী, সুষ্ঠু এবং টেকসই অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োজন, যাতে ঋণের বোঝা কমিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।