হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদসহ চার দফা নির্দেশনা ও ৯ দফা সুপারিশ করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাউজককে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
সোমবার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়েছে, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি বহাল থাকবে বলে
এদিন আদালতে রাজউকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ব্যারিস্টার ইমাম হাসান। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ মে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদসহ চার দফা নির্দেশনা ও ৯ দফা সুপারিশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের স্বাক্ষরে ২৪ মে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫৫ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। এই রায় স্থগিত চেয়ে গত বছর জুনে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাজউ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ নভেম্বর হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউককে লিভ টু আপিল দায়ের করতে বলেন। সে অনুযায়ী রাজউক লিভ টু আপিল দায়ের করে। আজ লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে রাজউককে আপিল দায়ের করতে বলেন আপিল বিভাগ।
জানা গেছে, হাইকোর্ট রায়ে হাতিরঝিলের পানি এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও মহামূল্যবান এই জাতীয় সম্পত্তি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো:
১. সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি তথ্য জনগণের ন্যাস সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি।
২. হাতিরঝিল এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ এবং নির্মাণ-সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদীর রায় অনুযায়ী বেআইনি এবং অবৈধ।
৩. হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দ করা সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে এসব বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো।
৪. রায়ের অনুলিপি প্রাপ্তির পরবর্তী ৬০ দিনে মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য প্রতিপক্ষদেরকে (রিটের বিবাদীরা) নির্দেশ দেয়া হলো।
এছাড়াও, আদালত হাতিরঝিলের বিষয়ে ৯ দফা সুপারিশসহ পরামর্শ দেয়া হলো। সেগুলো হলো:
ক. হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিচালনার নিমিত্তে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ তথা হাতিরঝিল লেক সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি অধীন গঠন করা।
খ. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ইঞ্জিনিয়ারিং কন্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ করা।
গ. জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিক মানের টয়লেট স্থাপন করা।
ঘ. নির্ধারিত দূরত্বে বিনামূল্যে সব জনসাধারণের জন্য পান করার পানির ব্যবস্থা করা।
ঙ. পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরি করা।
চ. পানির জন্য ক্ষতিকর হেতু লেকে সব ধরনের যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
ছ. লেকে মাছের অভয়ারণ্য করা।
জ. হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা।
ঝ. হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয় রেভিনিউ (রাজস্ব) বাজেট থেকে বরাদ্দ করা।
মামলার বিবরণে জানা যায়, রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টকে পাবলিক ট্রাস্ট (জনগণের সম্পত্তি) ঘোষণা করে ২০২১ সালের ৩০ জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ ওইদিন এ রায় দেন।
এর আগে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টে লে-আউট প্লানের নির্দেশনার বাইরে কতিপয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধে রাজউকের নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
পরে ২০২১ সালের ৩০ জুন ওই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।