আদিবাসীদের নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মৌলিক অধিকার রয়েছে। বাঙালিদের ‘বাঙালি’ না বলে ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠী’ বললে কেমন লাগবে? এমনই প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে সরকারি নির্দেশনার কড়া সমালোচনাও করেন তিনি।
বুধবার(১০ আগস্ট) বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীসমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে
তিনি এসব কথা জানান।
৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন উপলক্ষে এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ডেইলি স্টার ভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে গত ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টক শোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
সন্তু লারমা বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যদি জনমানুষের শাসনব্যবস্থা থাকত, তাহলে সরকারের বিশেষ মহলের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো না। সংবিধানপরিপন্থী উল্লেখ করে আদিবাসী শব্দটিকে গণমাধ্যম, টক শো ও প্রশাসনিকভাবে ব্যবহার না করার নির্দেশ জারি হয়েছে। সরকার একটি শব্দ নিয়ে নানাভাবে তার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করছে। সন্তু লারমা প্রশ্ন করেন, এ সরকারকে কি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, গণমুখী, দুর্নীতিমুক্ত বলে আখ্যায়িত করা যাবে?
তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ সরকার গঠিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,
সরকার সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, প্রগতিবিরোধী, ধনী-গরিবের বৈষম্যের স্বীকৃতি দেয় এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিভক্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।
সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসীদের প্রশাসনিকভাবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে। আদিবাসীদের পরিচিতি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। আমি আমার পরিচয় দিতে চাই। কী নামে পরিচিত হব, সেটা আমার মৌলিক অধিকার। সরকার তো সে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
১৯৭২-এর সংবিধানে বলা আছে, বাংলাদেশে যারা বাস করবে, তারা বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে এ তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, সেখানেই আদিবাসীদের পরিচয় চিহ্নিত হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে নানা সংশোধনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু বহু জাতির আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বাঙালি না বলে যদি আমরা বৃহৎ জনগোষ্ঠী বলে ডাকি, তখন কেমন লাগবে তাদের কাছে?
এ আলোচনা সভায় নারীদের অধিকার প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীকে যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখন সেই রাজনীতিতে যেতে হবে, যে রাজনীতি নারীর প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করে। দেশে সেই রাজনীতি অত্যন্ত দুর্বল। নারীর সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেই লড়াইয়ে যুক্ত হতে হবে পুরুষকে।
এ সময় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল আদিবাসীদের নিরাপদ রাখা। সেটা হয়নি। আদিবাসী শব্দ কেন পরিহার করতে বলা হয়েছে, সেটার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।