সাজ্জাদ শরিফ
দুর্বল, অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে হীনচোখে দেখা দুনিয়ার রীতি। ধন-সম্পদ, যশ-খ্যাতি ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তিকেই সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে এটি সম্মান-অসম্মানের মাপকাঠি নয়। নিঃস্ব-অসহায় মানুষও তাকওয়ার অধিকারী হলে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হয় সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করে, সে-ই বেশি মর্যাদাবান। (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
মহান আল্লাহ মানুষকে ধনী-গরিব করেই সৃষ্টি করেছেন। কিছ মানুষকে ধনী করেছেন আবার কিছু মানুষকে বানিয়েছেন গরিব ও দরিদ্র হিসেবে। রিজিকের এই হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর পরীক্ষা। ধনীর জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালন ও মানুষের অধিকার আদায়ের পরীক্ষা আর গরিবের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য-স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি কখনো আপনি দৃষ্টি প্রসারিত করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেওয়া জীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও স্থায়ী। (সুরা : তহা, আয়াত : ১৩১)
সবাইকে ধন-ঐশ্বর্যের মালিক বানানো আল্লাহর রীতি-বিরুদ্ধ। এর ফলে মানুষ অহংকার-ঔদ্ধত্য প্রকাশের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করত। অনিবার্য হয়ে উঠত পৃথিবীর ধ্বংস। আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহ তার সব বান্দাকে জীবনোপকরণে প্রাচুর্য দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করত। কিন্তু তিনি তার ইচ্ছামতো যথাযথ পরিমাণে রিজিক অবতীর্ণ করেন। তিনি তার বান্দাদের ভালোভাবেই জানেন ও দেখেন। (সুরা : শুরা, আয়াত : ২৭)
অপরদিকে যারা দারিদ্রের মাঝে জীবন কাটায়, অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করে, সমাজের অভিজাত শ্রেণির কাছে অবহেলিত ও উপেক্ষিত থাকে, প্রিয়নবী তাদের ধৈর্য৷ ও অল্পতুষ্টের অনুপম এক আদর্শের দীক্ষা দিয়েছেন। দিয়েছেন চূড়ান্ত সফলতার এক অনন্য সার্টিফিকেট। হাদিসের অমর বাণীতে তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, মোটামুটি প্রয়োজন মতো রিজিক পায় এবং আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকে, সে সফল। (সহিহ মুসলিম)
পৃথিবীতে দারিদ্র্য আল্লাহর বড় নেয়ামত। আল্লাহভীরু গরিব ও দুর্বল-অসহায়দের কারণেই আল্লাহ অবারিত রিজিক দান করেন। সাহাবি সাদ রা. দরিদ্র সাহাবিদের চেয়ে নিজেকে অভিজাত মনে করলে রাসুল সা. বলেন, দুর্বল লোকদের দোয়ার কারণেই তোমাদের সাহায্য করা হয় এবং রিজিক দেওয়া হয়। (বুখারি, মিশকাত)
প্রিয়নবী সা. দরিদ্রদের জন্য অসংখ্য সুসংবাদ দিয়েছেন। ধনীরা প্রাচুর্যের সরোবরে ডুব দিয়ে ভুলে যায় পরকালের কথা। অভাব-অনটন ও পার্থিব অবহেলা মানুষকে আল্লাহমুখী করতে সহায়তা করে। তাই দরিদ্র মানুষই পরকালের জন্য নিজেকে অধিক প্রস্তুত করতে পারে। রাসুল সা. বলেন, আমি কি তোমাদের জান্নাতিদের সম্পর্কে জানাবো? তারা হলো প্রত্যেকে দুর্বল, অসহায় ও অবহেলিত ব্যক্তি। সে যদি আল্লাহর নামে কসম করে, তা তিনি পূর্ণ করে দেন। তিনি আরও বলেন, আমি কি তোমাদের জাহান্নামিদের সম্পর্কে বলব? তারা হলো প্রত্যেকে রূঢ় স্বভাব, কঠিন হৃদয় ও দাম্ভিক ব্যক্তি। (বুখারি ও মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে তিনি বলেছেন, আমি জান্নাতে উঁকি মেরে দেখলাম, এর বেশির ভাগ বাসিন্দা গরিব-মিসকিন।…।’ (মুসলিম)
দুনিয়াবঞ্চিত গরিব অসহায়দের জন্য সুখের বিষয় হলো, ধনীদের আগেই তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে দুর্বল, অসহায় ও দরিদ্র মানুষগুলো অবমূল্যায়িত হলেও আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে সবার আগে জান্নাতে প্রবেশের মহাসম্মানে ভূষিত হবে। নবীজি বলেন, দরিদ্ররা তাদের ধনীদের চেয়ে ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজি)
আল্লাহর কাছে কখনোই অঢেল ধন-সম্পদ চাননি রাসুল সা.। বরং তিনি দারিদ্র্যই কামনা করেছেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা.বলেন, হে আল্লাহ, আমাকে দরিদ্র অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখো, দরিদ্র থাকা অবস্থায় মৃত্যু দিয়ো এবং কেয়ামতের দিন দরিদ্রদের দলভুক্ত করে হাশর করো। (এ কথা শুনে) আয়েশা রা. জানতে চান, আল্লাহর রাসুল! এমন কথা বলছেন কেন? তিনি বলেন, আয়েশা! তারা তাদের সম্পদশালীদের তুলনায় ৪০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হে আয়েশা! কখনো ভিখারীকে ফিরিয়ে দিয়ো না। ফকিরকে অন্তত একটি খেজুরের টুকরো হলেও দিয়ো। আয়েশা! তুমি দরিদ্রদের ভালোবাসবে এবং তোমার সান্নিধ্যে তাদের রাখবে, তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তোমাকে তাঁর সান্নিধ্যে রাখবেন। (তিরমিজি)
দারিদ্রতা সমাজের জনজন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত দারিদ্র্য মানুষের ইমাম-আমল নষ্ট করে। ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমন দারিদ্র্যের জীবন কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। তাই হালাল জীবিকা উপার্জনের পথে চলার চেষ্টা করতে হবে সামর্থ্যবান প্রতিটি মানুষকে। এব্যাপারেও নবীজি সতর্ক করে বলেছেন, অনেক দারিদ্র্য কুফরির দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ বিপথগামিতার দারিদ্র্য থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখুন।