মুফতি ওলিউর রহমান
আল্লাহ তায়ালাই জীবন ও মৃত্যুর মালিক। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। সবার রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের রিজিক দেয়ার মালিকও তিনিই। কুরআনে এসেছে, “যমীনে বিচরণশীল এমন কোনো জীব নেই যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই, তিনি জানেন তাদের থাকার জায়গা কোথায় আর কোথায় তাদেরকে (মৃত্যুর পর) রাখা হয়, সব কিছুই আছে সুস্পষ্ট লিপিকায়।” (সুরা হুদ:০৬) যদি তাই হবে, তাহলে কখনো সখনো দুনিয়ায় অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ কেন আসে? কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা এর বেশকিছু কারণ খুঁজে পাই। এখানে কিছু উল্লেখ করা হল।
১. ঈমান ও তাকওয়ার অনুপস্থিতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও জমিন থেকে বরকতসমূহ তাদের ওপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” (সুরা আরাফ-৯৬) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন: “আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।” (সুরা তালাক : ২-৪)
২. মানুষের ওপর জুলুম করা। পারস্পরিক দয়া ও সহানুভূতি ওঠে যাওয়া। হাদিসে এসেছে, “নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।(সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৪১)
৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। বুখারি শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি চায় যে, তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বর্ধিত হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখে।” (সহি বুখারি: ৫৯৮৬)
৪. জাকাত না দেয়া এবং মাপে কম দেয়া। সুনানে ইবনে মাজায় এসেছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেনঃ হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, শাসকের তরফ থেকে অত্যাচার কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যখন যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন।” (সুনানে ইবনে মাজা:৪০১৯)
৫. জমিনে অশান্তি ছড়িয়ে পড়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে স্থলে ও জলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, ২৩ আল্লাহ তাদেরকে তাদের কতক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন বলে, হয়ত (এর ফলে) তারা ফিরে আসবে।” ( সুরা রোম: ৪১) জলে-স্থলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার অর্থ হচ্ছে কল্যাণ কমে যাওয়া। জীবন ও জীবিকার মাধ্যমগুলো সংকোচিত হয়ে যাওয়া। আর এই অশান্তির কারণ হচ্ছে মানুষের জীবনাচরণ নষ্ট হওয়া সহ এমনসব প্রতিবন্ধকতা প্রকাশ পাওয়া, যাতে করে আকাশ ও জমিনের রহমত ও বরকত বন্ধ হয়ে যায়।
দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে যা করতে হবে—
১. খাঁটি মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যেমন হযরত নুহ আলাইহিস সালাম তাঁর উম্মতকে বলেছিলেন :
“অতঃপর বলেছি: তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।
তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন।
তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন। (সুরা নুহ: ১০-১২)
২. নেক আমলের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “পুরুষ আর নারীদের মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে আর সে মু’মিনও, তাকে আমি অবশ্য অবশ্যই উত্তম জীবন দান করব আর তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই তারা যা করে তার চেয়ে উত্তম প্রতিফল দান করব। ” (সুরা নাহাল:৯৭)
আজ আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের যে কালো মেঘের মহড়া দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকে দীনের পথেই ফিরে আসতে হবে। অতিমাত্রায় বস্তুবাদি হয়ে আমরা যে রঙমহল গড়ে তুলেছি, আজই আমাদেরকে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিলাসী জীবন ত্যাগ করতে হবে। অপচয় রোধ করতে হবে। হালাল কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলেই আমরা বাঁচতে পারব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
লেখক:
শিক্ষক, অনুবাদক, কলামিস্ট