সমাজের অন্যান্য শিশুর মতো স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে ওঠাটা হয়ে উঠেনি স্মৃতি রায়ের৷ জন্মের পর থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় যেন থেমে আছে তার জীবন। দরিদ্র মা-বাবা অর্থের সংকটের কাছে অসহায়। চিকিৎসা তো বিলাসিতাই বলা চলে। চিকিৎসা অভাবে এমনি করেই কেটেছে প্রতিবন্ধী স্মৃতির জীবন। বয়স থেমে থাকেনি, বিনাচিকিৎসায় দেখতে দেখতে স্মৃতি এখন চৌদ্দ বছরে। কখনও দুইপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি সহায়হীন এই শিশু।
যখন চলছে শারদীয় দুর্গোৎসব, শিশুরা মেতে উঠছে আনন্দ-উল্লাসে। একই বয়সী স্মৃতির শারীরিক অক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ওর হাসি কিংবা দুরন্তপনা।
দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের দিনেও অশ্রু সিক্ত স্মৃতির মা-বাবা। দীর্ঘদিনেও একমাত্র কন্যা স্মৃতির জন্য পারিবারিক আয়ে একটি হুইল চেয়ারের জোগাড় করা তাদের হয়ে উঠেনি। এমন যাতনা যেন বড় বড় উৎসবগুলোতে মা রাধা রানী রায় ও বাবা বিষ্ণু রায়কে কিঞ্চিৎ বেশি করেই কাঁদায়।
এই উৎসবের আমেজ এবার স্মৃতি রায় পেয়েছে, মুখে ফুটেছে হাসি। হাসছেন তার মা-বাবাও। বিজয়া দশমীতে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু স্মৃতি রায়ের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছেন মানবিক পুলিশ খ্যাত শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। রংপুর সদর কোর্টের সহকারী টাউন সাব-ইন্সপেক্টর (এটিএসআই) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এই পুলিশ সদস্য।
রংপুর নগরীর কামারপাড়াতে বসবাস করা শিশু স্মৃতি রায়ের মা-বাবা কাছে বুধবার একটি উন্নতমানের হুইল চেয়ার নিয়ে হাজির হন পুলিশ সদস্য শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। এসময় সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন কামারপাড়া কুতুবিয়া জামে মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক মামুন, সদ্যপুষ্কুরিণী ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সাইফুর রহমান বাবু, অগ্রণী সংঘের সদস্য সচিব মমিনুল ইসলাম রিপন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, রংপুর মহানগরীর ২২নং ওয়ার্ডের কামারপাড়া গ্রামের বিষ্ণু রায় ও রাধা রাণী রায় দম্পতির শিশুকন্যা শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী স্মৃতি রায়। জন্মের কয়েকমাস পর স্মৃতির শারীরিক অসুস্থতা বুঝতে পারেন তার পরিবার। স্মৃতির বাবা বিষ্ণু রায় পেশায় একজন রং মিস্ত্রি। আর্থিক দৈন্যদশায় শারীরিক প্রতিবন্ধী কন্যার কোনো চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। একাই চলাফেরা করতে না পারা স্মৃতি ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। অন্যের হাত ধরে নয়তো কোথাও ভর করে হাঁটতে হয় তাকে।
গত কয়েকদিনে আগেই স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মীর প্রচেষ্টায় উঠে আসে স্মৃতির এই জীবনের কথা। প্রতিবন্ধী শিশু স্মৃতি রায়ের দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে পারেন রংপুর সদর কোর্টের এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর তিনি ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুধবার বিকেলে স্মৃতিকে একটি হুইল চেয়ার প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে স্মৃতির মা রাধা রাণী রায় বলেন, আমার দুটি ছেলে-মেয়ে। এরমধ্যে সবার বড় স্মৃতি আর ছোটটা ছেলে। জন্মগতভাবে স্মৃতি শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমার স্বামী রং মিস্ত্রি। মেয়ের চিকিৎসা করার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। খুব কষ্টে সংসার চলছে। এখন মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, একা হাঁটাচলা বা খেতেও পারে না আমার স্মৃতি। অন্য কারো হাতেও খেতে চায় না। ওর মনের মধ্যে খুব ভয়ভীতি কাজ করে। কখনো হাসতেও চায় না। কিন্তু আজকে হুইল চেয়ারে বসার পর ওর চোখে মুখে হাসি ছিল। পুলিশ ভাই আমার মেয়েকে হুইল চেয়ার দিয়েছে। মেয়েটা আমার এখন খুব খুশি।
এই মানবিক এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজ রহমান পুলিশে যোগদান করেন ২০০০ সালের দিকে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছেন আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ২০২০ সালে গাজীপুরে হাইওয়ে পুলিশে থাকাকালীন ঘুষ বিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন।
এ ব্যাপারে রংপুর কোর্ট পুলিশের এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজ রহমান বলেন, আমি আমার নিজ উদ্যোগে অবসর সময়ে সামর্থ্য অনুযায়ী এসব মানুষদের সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়, আমরা সবাই যদি সবার জায়গা থেকে একটু একটু এগিয়ে আসি, তাহলে সমাজে অসহায় গরিব মানুষেরা দুঃখ কষ্ট ভুলে একটু ভালো অবস্থায় ফিরতে পারবে।
তিনি বলেন, চাকরি জীবনের ২২ বছর পুলিশ বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন এমন গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমি চার বছর আগে ফুড ব্যাংক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। এ ধরনের মানবিক কাজ করতে আমার ভালো লাগে। আত্মার মধ্যে অন্যরকম শান্তি পাই।
