বাংলাদেশে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনাগুলো ট্র্যাক করেছেন এমন দুজন মানবাধিকার কর্মীকে বৃহস্পতিবার দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশটিতে নতুন করে ভিন্নমত দমনের মাত্রা বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং এএসএম নাসির উদ্দিন এলানকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের অধীনে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের আগে ১৭ কোটি মানুষের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করে ধরে রেখেছেন। ভিন্নমতের কণ্ঠকে হয়রানি ও দমন করার জন্য গত ১৪ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব ব্যাপকভাবে দখল করেছেন। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান হলো দেশটির বিচার বিভাগ। ক্রমবর্ধমানভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা বিচার ব্যবস্থায় বিরোধীদলীয় সমর্থক, নেতাকর্মী এবং সাংবাদিকরা আটকা পড়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নেতা আদিলুর ও নাসিরের বিরুদ্ধে মামলাটির সূচনা- এক দশক আগের একটি নৃশংস ঘটনা নিয়ে তাদের করা একটি ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট’ থেকে। ২০১৩ সালের ওই রিপোর্টে দেখা গেছে, কট্টরপন্থি ইসলামি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত একটি সমাবেশ নির্মূল করার জন্য পুলিশ গুরুতর নির্যাতন চালিয়েছে।
‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি ওই বছরের মে মাসে নবী মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য ও কার্টুনের প্রতিবাদে ঢাকাকে অচল করে দেয়। এর জবাবে, পুলিশ গভীর রাতের ক্র্যাকডাউনে ওই এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং নির্মম সহিংসতা চালায়।
বিরোধী দলগুলো শত শত মানুষ নিহত হওয়ার অভিযোগ করেছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংখ্যাটি ছিল আনুমানিক ডজনখানেক থেকে ৫০ এর মধ্যে। তবে অধিকারের রিপোর্ট জানায়, নিহত ৬১ জনের নাম পাওয়া গেছে।
রিপোর্টটি প্রকাশের পরপরই শেখ হাসিনার সরকার ওই দুই মানবাধিকার কর্মীকে আটক করে। আদিলুর খানকে ৬২ এবং নাসিরকে ২৫ দিনের জন্য আটকে রাখে। তাদের রিপোর্টকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ী বিকৃত এবং মানহানিকর বলে অভিহিত করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পদস্থ ব্যক্তিরা বলতে থাকেন, অপারেশনের সময় কেউ নিহত হয়নি।
দুই মানবাধিকার কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টিকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হিসেবে নথিভুক্ত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যৌথ চিঠি প্রকাশ করে। সেখানে তারা মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি চেয়েছে।
সংস্থাগুলো বলছে, তহবিল পেতে বাধা দেওয়া এবং রেজিস্ট্রেশন নবায়ন না করাসহ বিভিন্নভাবে সরকার মানবাধিকার কর্মীদের এবং অধিকারকে হয়রানি অব্যাহত রেখেছে।
ওই যৌথ চিঠিতে বলা হয়েছে- হয়রানি, ভয়ভীতি এবং প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই মানবাধিকার কর্মীদের প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে দেওয়া উচিত। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত এবং প্রকাশ করেন, তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে; সরকারের উচিত (ঘটনাগুলো) তদন্ত করা এবং (মানবাধিকার) লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের জবাবদিহি করা।
বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে অধিকারকে ‘ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণিত রেকর্ড থাকা অসঙ্গত ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট একটি সত্তা’ বলে অভিহিত করেছে। সরকারের ভাষ্য, বিচার বিভাগ ‘প্রমাণের ভিত্তিতে এবং আইন অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে’।