বাইসাইকেল দিয়ে কয়েকবার বিশ্বভ্রমণ করা ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দখলে রেখেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। কেবল দখল নিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ভেঙেছেন একাধিক স্থাপনা। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা অনেক চেষ্টা করেও সেই বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পারেনি। বাড়িটি দেখতে গিয়ে কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও পর্যটকরা।
১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন রামনাথ বিশ্বাস। তার পিতার নাম বিরজানাথ বিশ্বাস ও মাতার নাম গুণময়ী দেবী। রামনাথ বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই। কর্মস্থল সিঙ্গাপুর থেকে পৃথিবীর পথে বের হন রামনাথ বিশ্বাস। তিন দফায় ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে তিনি পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরছেন। তাঁর দীর্ঘ সাইকেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও গল্প–উপন্যাস লিখেছেন। সবমিলিয়ে রামনাথ বিশ্বাসের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০।
বিশ্বজয়ী ভূপর্যটকের শেষ জীবন কেটেছে ভারতের কলকাতায় কেটেছে। ১৯৫৫ সালের ১৯ নভেম্বর সেখানেই মারা যান। কলকাতা শহর রামনাথকে মনে রেখেছে। তাঁর নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে—রামনাথ বিশ্বাস লেন।
তবে হবিগঞ্জে রামনাথ বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উপরন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওয়াহেদের দখলে নষ্ট হয়েছে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি। অভিযুক্ত আব্দুল ওয়াহেদ স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।
স্থানীয়রা জানান, রামনাথ ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল বাড়িটি। ১৯৮০-এর দশকে ওয়াহাব উল্লাহ নামে প্রভাবশালী একজন এই সম্পত্তি দখল করে নেন। ২০০০ সালের পর তিনি আবদুল ওয়াহেদের কাছে জায়গাটির দখল বিক্রি করেন।
আবদুল ওয়াহেদ ও তার বড় ভাই আবু ছালেকের দখলে সেই থেকে রয়েছে বাড়িটি। আবু ছালেকের বিরুদ্ধে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আর বাড়ির দখল নেয়ার সময় আবদুল ওয়াহেদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে আবু ছালেক এলাকা ছাড়েন। অন্যদিকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলে রাখতে আবদুল ওয়াহেদ নিজের নামে ভুয়া নামজারি করে নেন। তবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও রামনাথ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনলে সেই নামজারি বাতিল হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, আব্দুল ওয়াহেদ একজন এলাকার প্রভাবশালী লোক। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি তার অবৈধ দখলে রয়েছে। আর এক্ষেত্রে তিনি আওয়ামীলীগের পদ পদবী ব্যবহার করছেন। বর্তমানে তিনি ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে দুই নম্বর বানিয়াচং উত্তর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া বলেন, ওয়াহেদ একজন দখলদার। রামনাথ বিশ্বাসেরই বাড়িটি তিনি দখল করে রেখেছেন।
অনেক সময় চেষ্টা করেও আমরা বাড়িটিকে দখলমুক্ত করতে পারিনি। তিনি কিছুদিন পরপরই বাড়িকে নিজের নামে নামজারি করে ফেলেন। কিন্তু আমরা সেটাকে বাতিল করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গেরিলা দলের অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দারুজ্জামান খান বলেন, আব্দুল ওয়াহেদের বড়ভাই আবু ছালেক এই এলাকার চিহ্নিত আলবদর। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।
বাড়িটি দখলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। সর্বশেষ হবিগঞ্জের স্থানীয় চারজন সাংবাদিক ৬ সেপ্টেম্বর ওই বাড়িতে গিয়ে হামলার শিকার হন। এর চার দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূর দখলদারদের হামলার শিকার হয়েছেন। এ সময় স্থানীয় আরও তিনজন সাংবাদিককেও মারপিট করেন আবদুল ওয়াহেদ ও তার ছেলেরা।
তবে হামলা এবং বাড়ি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করছেন আবদুল ওয়াহেদ। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘এ বাড়ি রামনাথ বিশ্বাসের না। এই এলাকার কেউ এটিকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি বলে প্রমাণ করতে পারবে না। সাংবাদিকরা এখানে এসে আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করে। আপনারা আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। না হলে খারাপ হবে।’