মুফতি ওলিউর রহমান
মুদ্রাস্ফীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ব্যক্তি ও সমাজকে এটি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এর যেমন স্বাভাবিক ও যৌক্তিক কারণ রয়েছে, তেমনি কৃত্রিম সংকটও রয়েছে। কাঁচা মালের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে এর একটি যৌক্তি কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এই বৃদ্ধি যদি হয় অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম, তখন আর এর কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এটি তখন পুরো সমাজকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় মানুষের উচ্চাকাঙ্খা ও বিলাসি মানসিকতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এজন্যে ইসলাম আমাদেরকে বিলাসিতা ও লোভের ব্যাপারে কড়াভাবে সতর্ক করেছে। কেননা, একটি জাতি নষ্ট হবার জন্যেই এই বিলাসিতাই দায়ি। এর কারণেই একটি উন্নত জাতির পতন হয়। এই বিলাসিতার সবচে খারাপ দিক হচ্ছে, এতে করে মানুষ দুনিয়ামুখি ও আখেরাতবিমুখ হয়ে যায়। বিলাসিতাকে কুরআনে অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। “অতএব তোমাদের পূর্বের প্রজন্মসমূহের মধ্যে এমন প্রজ্ঞাবান কেন হয়নি, যারা যমীনে ফাসাদ করা থেকে নিষেধ করত? অল্প সংখ্যক ছাড়া, যাদেরকে আমি তাদের মধ্য থেকে নাজাত দিয়েছিলাম। আর যারা যুলম করেছে, তারা বিলাসিতার পেছনে পড়ে ছিল এবং তারা ছিল অপরাধী। তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে কোন জনপদ ধ্বংস করবেন এমতাবস্থায় যে, তার অধিবাসীরা সদাচারী” (সুরা হুদ:১১৬-১১৭)। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. তাঁকে ইয়ামানের গভর্ণর করে পাঠানোর সময় উপদেশ দিয়ে বলেন: “তুমি বিলাসিতা থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহর খাঁটি বান্দারা বিলাসি নয়।” (সহি তারগিব তারহিব: ০২/২৪৬) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা.-এর কাছে একটি পাত্রে দুধ ও মধু নিয়ে আসা হয়। তিনি বললেন: “একই পাত্রে দুই জাত? আমি এটি খাবও না, হারামও করব না।” (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ০৫/৩৭) ইসলামি বিজয়াভিযান শুরু হলে সাহাবায়ে কেরাম ভোগ-বিলাসের ক্ষতি সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারেন। ফলে, তাঁরা একে অন্যকে নসিহত করতেন। আবু উসমান নাহদি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “হযরত ওমর রা. আমাদেরকে পত্র লিখলেন— আমরা তখন আজারবাইজান অভিযানে ছিলাম-
হে উৎবা! এ সম্পদ তোমার অথবা তোমার বাবার-মা’র কষ্টার্জিত নয়। অতএব, এর থেকে তুমি নিজের ঘরে যেমন পেটপুরে খাও, তেমনি মুসলিমদের বাড়ি গিয়ে তাদেরকে তৃপ্তিসহ খাওয়াও। সাবধান! বিলাসিতা, মুশরিকদের বেষভূষা এবং রেশমি কাপড় পরিধান করা থেকে বেঁচে থাকবে।” (সহি মুসলিম: হা. ৫২৩৭) বিলাসিতার কারণে যেসব সমস্যা হয়, এখানে কিছু তুলে ধরা হল—
এক. বিলাসিতা ও ভোগবাদ মানুষকে সম্পদ অর্জনে প্রতিযোগি করে তুলে। দুই. বিলাসিতা ও ভোগবাদের কারণে আত্মা পাষাণ হয়ে যায়। আখেরাত বিস্মৃত হয়ে যায়। তিন. বিলাসি জাতির দ্রুত পতন ও পরাজয় ঘটে।
মুদ্রাস্ফীতির ধকল থেকে বাঁচতে শরয়ী নীতিমালা
এক. তাকওয়া ও আল্লাহমগ্নতায় নিজেকে গড়ে তোলা।
কুরআনে এসেছে, “আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” (সুরা আরাফ: ৯৬) তাকওয়া হচ্ছে রিজিক বৃদ্ধি ও বরকতের কারণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন।এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।” (সুরা তালাক: ০২-০৩)
দুই. আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও দোয়া করা
“আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’। ‘তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন,‘আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা’।” (সুরা নুহ: ১১-১২) আরেক আয়াতে এসেছে, “আর আমি তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের কাছে বহু রাসূল পাঠিয়েছি, আমি তাদের প্রতি ক্ষুধা, দারিদ্রতা ও রোগ ব্যাধি চাপিয়ে দিয়েছি, যেন তারা নম্রতা প্রকাশ করে আমার সামনে নতি স্বীকার করে। সুতরাং তারা কেন বিনীত হয়নি, যখন আমার আযাব তাদের কাছে আসল? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে। আর তারা যা করত, শয়তান তাদের জন্য তা শোভিত করেছে।” (সুরা আনআম: ৪২-৪৩)
তিন. সামাজিক সহযোগিতা, জাকাত ও সদকা আদায় করা
জাকাতের মাধ্যমে গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য করা হয়। ধনীদের হাত থেকে নিয়ে গরিবের হাতে অর্পণ করা হয়। এভাবে সম্পদ সমাজের এক শ্রেণির মানুষের হাতে কুক্ষিগত হবার বদলে সুষমভাবে বণ্টিত হয়ে আর্তমানবের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। ফলে, সমাজ দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পায়। জাকাত না দিলে বিপদাপদ আসে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আজকে সমাজের শ্রেণিবৈষম্য ও হানাহানির মূল কারণ হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভা না থাকা। জাকাতের মাধ্যমে সম্পদে বরকত আসে। মানুষে মানুষে ভালোভাসা ও মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। এতে করে যেমনিভাবে বুর্জোয়াদের দৌড়াত্ম কমে যায়, তেমনি সর্বহারা শ্রেণিরও উদ্ভব ঘটে না।
চার. পরিতৃপ্ত মানসিকতা লালন করা।
রাসুল সা. বলেন: “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তা নিয়ে খুশি থাক। সর্বাধিক ধনী হয়ে যাবে।” (তিরমিজি: হা.১৮৭৬) হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: মাসের পর মাস চলে যেত, রাসুল সা.-এর ঘরে আগুন জ্বলত না (অর্থাৎ, কোনো কিছু রান্না করা হত না)। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আপনারা কী খেতেন? তিনি বললেন: খেজুর ও পানি। (বুখারি: হা. ৬৪৫৯)
পাঁচ. পরিমিতিবোধ জাগ্রত করা, অপচয় রোধ করা
বিলাসিতার আরেকটি ধরন হচ্ছে নানান রকমের খাবারের আয়োজন। এটি একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয়, এতে করে যেমনিভাবে আমরা আমাদের পাপের বোঝা ভারি করছি, তেমনি অসহায় মানুষের হকও নষ্ট করছি। ডাক্তারদের মতে, আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতেই সমস্ত চিকিৎসা রেখে দিয়েছেন— “এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।” (সুরা আরাফ: ৩১) প্রয়োজন পরিমাণ খাবার আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্যে বৈধ করেছেন। কিন্তু অপচয় করা যাবে না। সর্বক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে হবে। এমন যেন না হয়, আজকে আছে তো যথেচ্ছা ভক্ষণ করলাম। আর আগামীকাল ক্ষুধার্ত থাকলাম। এটা কোনো সুস্থ চিন্তা হতে পারে না।
ছয়. মজুদ্দারি ও মূল্যাবৃদ্ধি রোধ করা
ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিধিবদ্ধ পন্থায় পণ্য মজুদ করা ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। হাদিসে এসেছে, “চল্লিশ দিন যে পণ্য মজুদ করে রাখবে, সে আল্লাহর থেকে এবং আল্লাহ তার থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবেন।” (মুসনাদে আহমাদ: হা. ৪৮৮০)
লেখক: প্রবন্ধকার, অনুবাদক