বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ, কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজায় ঈদের কোনো উৎসব নেই। সেখানে আছে শুধু কান্না, ক্ষুধা আর বোমার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রতিদিন নতুন করে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) আদেশ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
রমজানের শেষদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও ১৮ মার্চ ইসরায়েল একতরফাভাবে তা ভঙ্গ করে নতুন করে হামলা শুরু করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ১৯৮৪ জন। ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণের ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার বহু এলাকা। খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলমান হামলায় নিহতের সংখ্যা ৫০,২০৮ ছাড়িয়ে গেছে, আর আহত হয়েছেন ১,১৩,৯১০ জন। তবে গাজার মিডিয়া অফিস বলছে, মৃতের সংখ্যা আসলে ৬১,৭০০-এর বেশি, যা আরও বাড়তে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।
গাজার সঙ্গে দক্ষিণ লেবাননেও ইসরায়েলি হামলা চলছে। এমনকি ২০২৩ সালের নভেম্বরে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর এবারই প্রথম লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ফলে লেবাননের পরিস্থিতিও আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল গাজায় তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশ বন্ধ রেখেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) সতর্ক করেছে, এই পরিস্থিতির ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ভয়াবহ অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। ঈদের সময় যখন মুসলিমরা পরিবারের সঙ্গে আনন্দ করছে, তখন গাজার মানুষ একটু খাবারের জন্য হাহাকার করছে।
গাজার এই বিপর্যয়ের মধ্যেও বিশ্ব থেকে কার্যত কোনো জোরালো প্রতিবাদ আসছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে পালিত হয়েছে আল কুদস দিবস। এটি জায়নবাদবিরোধী এবং ফিলিস্তিনপন্থী একটি ইভেন্ট, যা রমজানের শেষ শুক্রবার জুমাতুল বিদার দিন পালিত হয়। শিকাগোর বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন— “বর্ণবাদ: দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য খারাপ, ফিলিস্তিনের জন্যও খারাপ”। তবে অনেকেই নিরাপত্তার ভয় ও অভিবাসন নীতির কারণে বিক্ষোভে যোগ দিতে সাহস পাননি।
ইতিমধ্যে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় মাহমুদ খলিল নামে এক শিক্ষার্থীকে আটক করেছে মার্কিন প্রশাসন। মিশিগানের কংগ্রেসওমেন রাশিদা তায়েবসহ রাজ্যের কয়েকজন নির্বাচিত কর্মকর্তা তার মুক্তির দাবিতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, খলিলকে শুধুমাত্র তার ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত পরিচয়ের কারণে টার্গেট করা হয়েছে, যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের ফলে চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে আহতদের স্রোত সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে, চিকিৎসার অভাবে বহু মানুষ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন। রক্তের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকেরা প্রাণপণে আহতদের বাঁচানোর চেষ্টা করলেও ওষুধের অভাবে কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিয়েছে বলে ট্রাম্প প্রশাসন অভিযোগ তুলেছে এবং এর জেরে ওই সেন্টারের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় চলছে, তা পুরো বিশ্বের চোখের সামনে ঘটছে, কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ইসরায়েল যেন নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার “লাইসেন্স” পেয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা শিশুদের কান্নার ভিডিও, আহতদের আহাজারি— এসব কিছুই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ন্যূনতম নড়াচড়া করাতে পারছে না।
বিশ্বজুড়ে যখন মুসলিমদের ঘরে ঘরে ঈদের খুশি, তখন গাজার মানুষ বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে। খাবার, পানি, চিকিৎসা— সবকিছুই এখন তাদের জন্য দুর্লভ। এই ঈদ তাদের জন্য শুধুই বেঁচে থাকার আরেকটি দিন, নতুন কোনো আনন্দের বার্তা নয়।